প্রথম প্রকাশ: মুক্তমনায় আলাদা দুই খণ্ডে – প্রথম খণ্ড – দ্বিতীয় খণ্ড
এই বেয়াড়া প্রশ্ন তিনটি মাথায় চেপে বসেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এগুলোর কোন এক রকমের উত্তর দেয়া ছাড়া বোধহয় কোন ঐক্যবদ্ধ সমাজই গড়ে উঠতে পারে না। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ সমাজের গুরুজনদের কাছে যদি এত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরই উত্তর না থাকে তাহলে মানুষ কেন তাদের মান্য করবে? গুরুজনেরা তাই মনের মাধুরী মিশিয়ে উত্তর দিয়ে গেছেন যুগে যুগে। যার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে প্রতিটি সমাজের নিজস্ব পুরাণ। এক সময় গুরুজনেরা ভেবেছেন, প্রশ্ন করার আগেই যদি শিশুদের উত্তরটা জানিয়ে দেয়া হয় তাহলে বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা আরও কমবে। গুরুজনদের সেই উপলব্ধির শিকার আমরা সবাই। যেমন শিকার হয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত ফরাসি চিত্রকর পল গোগাঁ (১৮৪৮-১৯০৩)।
গোগাঁ কিশোর বয়সে খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের একটি শিক্ষাশ্রমে পড়তেন। সেখানকার বিশপ প্রাগৈতিহাসিক গুরুজনদের মতোই কিছু প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর প্রস্তুত করেছিলেন বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে। প্রশ্ন তিনটি ছিল- “মানবজাতি কোথা থেকে এসেছে?”, “তারা কোথায় চলেছে?”, “তারা কিভাবে এগোবে?” উত্তরগুলো ছাত্রদের শ্লোকের মত মুখস্থ করে ফেলতে হতো। ধার্মিকতার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ না থাকলেও প্রশ্নোত্তরগুলো গোগাঁর মনে গেঁথে গিয়েছিল। কিন্তু এক সময় তার জীবনের সব স্বাচ্ছন্দ্য চলে যায়। স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তির জন্য বা হয়তো এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই তিনি ফ্রান্সের শহরতলী ছেড়ে এক সময় পাড়ি জমান প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপ তাহিতিতে। হয়তো ভেবেছিলেন আধুনিক শহরের বাসিন্দাদের চেয়ে বিশুদ্ধ ও নির্মল কোন মানবগোষ্ঠীর কাছে আরও বিশুদ্ধ উত্তর থাকবে।
নতুন জীবন শুরুর উদ্দেশ্যে তাহিতিতে পৌঁছেই এক টুকরো জমি ভাড়া নিয়ে স্থানীয়দের দিয়ে নিজের একটি কুঁড়েঘর বানিয়ে নেন, জোগাড় করেন একজন তাহিতীয় নারীসঙ্গী। কিন্তু সুখ তার বেশিদিন সয় না- গোঁড়ালির গাঁটের পুরনো ব্যথাটা আবার জেঁকে বসে, মাঝে মাঝে কফের সাথে বেরিয়ে আসে রক্ত। অর্থকড়ি শেষ হয়ে যাওয়ার পর কেবল ভাত আর পানির উপর নির্ভর করতে হয় তাকে। দুঃসময়ে সঙ্গীটিও ছেড়ে যায়, বাড়িওয়ালা মারা যাওয়ার পর আইনবলে তাকে বাড়ি থেকেও উচ্ছেদ করা হয়। অবস্থা এতো সঙ্গীন হয় যে তিনি ছবি আঁকার উৎসাহটুকুও হারিয়ে ফেলেন। এমনই একটা সময়ে, ১৮৯৮ সালে, ডেনমার্ক থেকে চিঠি আসে- তার ২১ বছর বয়সের মেয়েটি মারা গেছে। তার কিশোরবেলার সেই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন, “যদি তুমি থেকেই থাক তাহলে তোমাকে আমি অবিচার ও অন্যের ক্ষতিসাধনের অভিযোগে অভিযুক্ত করছি”।
শারীরীক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সকল দিক থেকে বিধ্বস্ত গোগাঁ আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার আগে জীবনের শেষ ছবিটি আঁকতে মনস্থ করেন- কোন ধর্মের দৈববাণী নয়, যে ছবি হবে একজন শিল্পী ও সর্বোপরী একজন মানুষের অতি নিজস্ব টেস্টামেন্ট, যার বিষয়বস্তু হবে শুধুই মানুষের অস্তিত্ব। জীবনের এমন ক্রান্তিকালে অনেকেই এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। কিন্তু গোগাঁ চাচ্ছিলেন জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটার একটা মীমাংসা করে যেতে। সেই প্রশ্ন তিনটি তখনও তার মনে গাঁথা যা ফুটিয়ে তুলতে প্রয়োজন বিশাল ক্যানভাস। কিন্তু এতো লিনেন কেনার টাকা তার ছিল না। অগত্যা কয়েকটি বস্তা খুলে একটার সাথে আরেকটা জোড়া লাগিয়ে তৈরি করেন ৪.৫ মিটার লম্বা ও ১.৭ মিটার উঁচু ক্যানভাস। তুলি হাতে দেহের শেষ শক্তিটুকু ঢেলে দিয়ে এঁকে যান। এক মাসের মধ্যেই সমাপ্ত হয় পৃথিবীর সবচয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলোর একটি। ডানের সোনালী অংশটুকুতে নিজের নাম লিখেন আর উপরে বাম কোণায় লিখেন: “D’où Venons Nous / Que Sommes Nous / Où Allons Nous” যার বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়, “আমরা কোথা থেকে এসেছি? আমরা কী? আমরা কোথায় চলেছি?”

আপাতদৃষ্টিতে ছবিটির মধ্যে অবাস্তব কিছু নেই। নদীর ধারে একটি জঙ্গলের মাঝের ফাঁকা স্থানে অবসর কাটাচ্ছে তাহিতির কিছু মানুষ ও তাদের গৃহপালিত প্রাণীরা। স্থানটি তাহিতিই হবে কারণ পটভূমিতে মুরিয়া দ্বীপের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। ছবির চরিত্রগুলো মনে হচ্ছে মানানা দর্শনে বিশ্বাসী যা বলে, আজ বিশ্রাম কর, আর কাজগুলো সব তুলে রাখ অন্য কোন সময়ের জন্য। তবে এই বাস্তবতার মাঝেও ছবিতে একধরণের রহস্যময়তা আছে। কিছু গাছের বিপরীতে দণ্ডায়মান আধ্যাত্মিক মূর্তিটি দেখে মনে হয় ‘সে যেন পৃথিবীর কেউ নয়’, এক ধরণের নীল আভায় ভাস্বর তার রূপ, বনের কিছু গাছ ও লাতাপাতাও মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের জন্য সেই একই আভায় উদ্ভাসিত। পটভূমিতে সূর্যের আলোয় আলোকিত সাগরের সাথেই পুরোভূমির কি যেন এক সম্পর্ক আছে। সব মিলিয়ে মনে হয়, যেন মঞ্চে কোন রহস্য নাটকের অভিনয় চলছে। মনে হতে পারে এই রহস্যের পর্দা ভেদ করতে পারলেই হয়তো বোঝা যাবে গোগাঁ কি টেস্টামেন্ট রেখে গেছেন। সে চেষ্টা কম লোকে করেননি। শেষ পর্যন্ত আমাদের মেনে নিতেই হয়েছে এটি একটি আর্ট এবং এর অর্থ একেক জনের কাছে একেক রকম হতে পারে। তবে অন্তত এটুকু বলা যায়, গোগাঁর টেস্টামেন্টে কোন উত্তর ছিল না, তিনি কেবল প্রশ্ন তিনটিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
ছবিতে মানবচিত্র মোট ১২টি, আটটি নারীর, দুটি পুরুষের এবং দুটি শিশুর। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিনটি- একেবারে ডানে একটি নবজাতক, মাঝে একজন পুরুষ গাছ থেকে ফল পাড়ছে এবং একেবারে ডানে একটি বৃদ্ধ মহিলা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত। গোগাঁ নিজেই বেশ কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়েছিলেন, যদিও দর্শক হিসেবে তা আক্ষরিক অর্থে মেনে নিতে কেউ বাধ্য নয়। গোগাঁ বলেছিলেন, ছবিটিকে ডান দিক থেকে দেখা শুরু করতে হবে। ছবির আছে তিনটি ভাগ, ডানে ও বামে দুটি বৃত্তাংশ এবং মাঝখানে একটি উপবৃত্ত, একেকটি অংশ একেকটি প্রশ্নের প্রতিনিধিত্ব করে। ডানে নবজাতকের মাধ্যমে গোগাঁ প্রশ্ন রেখেছেন- আমরা কোথা থেকে এসেছি? তাকে ঘিরে আছে তিনজন নারী যারা শিশুর অস্তিত্বের সেই রহস্যের সাথে সবচেয়ে গভীরভাবে সম্পর্কিত। মাঝে গাছ থেকে ফল পাড়াকে তুলনা করা যায় অভিজ্ঞতার ফসল সংগ্রহের সাথে। একটি বালককে আবার ফল খেতে দেখা যাচ্ছে। অদূরেই একটি প্রতিমা, হাত উঁচু করে সে যে অতিপ্রাকৃতকে নির্দেশ করছে তা মানব জীবনে আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজনীয়তা ছাড়া আর কিছু নয়। আছে কিছু পোষা প্রাণী যাদের সাথে আমরা এই পৃথিবী ভাগাভাগি করি। আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েও প্রকৃতির একটি অংশ হিসেবে জীবনটা কাটিয়ে দেই আমরা। প্রকৃতির অংশ হিসেবে আমাদের জীবন ধারণ এবং প্রকৃতির নিঃসীম শূন্যতার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে জন্ম দেয়া সকল আধ্যাত্মিকতা ও শিল্প মিলেই আমরা, এর থেকে আলাদা কোন অর্থ নেই আমাদের অস্তিত্বের।
শেষ প্রশ্ন- আমরা কোথায় চলেছি- চিত্রিত হয়েছে একেবারে বামের বৃদ্ধার মাধ্যমে। একদিকে বৃদ্ধার গালে হাত দিয়ে বসার ভঙ্গিতে পূর্ণ আত্মসমর্পন স্পষ্ট, ছবিটি আবার পেরুভীয় মমির মতো, বলা যায় মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিতে প্রস্তুত এই বৃদ্ধা। অন্যদিকে আবার তার বসার ভঙ্গি দেখে মাতৃগর্ভের শিশুর কথাও মনে পড়ে যায়- যা ইঙ্গিত করে আরেকটি জন্ম বা আরেকটি সৃষ্টির। এই মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধার সাথে ডানে জন্ম নেয়া নবজাতকের কোন সম্পর্ক নেই, তাই একজনের মৃত্যু এবং আরেক জনের জন্মের ব্যাপারটি নিয়ে বেশি আলোচনার নিরর্থকতাও ফুটিয়ে তুলেছেন গোগাঁ, বৃদ্ধার পায়ের কাছে থাকা সাদা পাখিটির মাধ্যমে। পাখির পায়ে আবার একটি টিকটিকি আছে। তাহিতীয়রা টিকটিকিকে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সাথে সম্পর্কিত মনে করে। গোগাঁর পুরো ছবিটি যেন আরবি বা হিব্রু কবিতার একটি চরণ, ডান থেকে শুরু হয়ে যা বাম প্রান্তে গিয়ে শেষ হয়েছে, যে সমাপ্তি হয় অন্তহীন নয়তো সূচনার সাথে যুক্ত হয়ে একটি চিরন্তন চক্রের জন্ম দেয়। ছবিতে এক ধরণের নৈরাশ্য আর নাস্তিবাদ আছে: একজন মানুষ সারা জীবনভর এই প্রশ্ন তিনটির ভিন্ন উত্তর পেতে যত চেষ্টাই করুক না কেন, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে সে হয়ত বলতে বাধ্য হয়- প্রকৃতি পুরনোকে ধ্বংস করে নতুনের জায়গা করে দেয়ার জন্য, আমরা কেবল তার এই সৃজনশীলতা চরিতার্থ করার হাতিয়ার, যেমন একজন চিত্রকরের হাতিয়ার তার তুলি।
জীবন সম্পর্কে এই দর্শন এক অর্থে খুবই আধুনিক, যদি আধুনিক বলতে বিজ্ঞানের যুগকে বোঝানো হয়। গোগাঁর ছবি থেকে অধিবিদ্যার নির্যাসটুকু ঝেড়ে ফেললে অবশিষ্ট থাকে কেবলই বৈজ্ঞানিক বা প্রাকৃতিক বাস্তবতা- মানব জীবনের কোন পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য বা গন্তব্য নেই, নবায়নের চিরন্তন ধারায় সে এসেছে এবং নবায়নের স্বার্থেই তাকে চলে যেতে হবে, ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য চাইলে তার নিজেকেই তা সৃষ্টি করে নিতে হবে। মজার ব্যাপার হল, এই ছবি আঁকার ইতিহাসও অনেকটা প্রাগৈতিহাসিক মানব জীবনের মতো- কিছু প্রশ্ন মাথায় রেখে যার শুরু, প্রশ্নগুলোর কোন একটা উত্তর খুঁজে পেতে যার পথচলা, আর নিরুত্তর নিরবতায় যার সমাপ্তি। গোগাঁ এর থেকে বেশি কিছু চাননি, কারণ তিনি নিজেও মনে করতেন বিষয়কেন্দ্রিক উত্তর পেতে যুক্তির দ্বারস্থ হওয়াই যুক্তিযুক্ত, বিষয়ীকেন্দ্রিক (সাবজেক্টিভ) কল্পনার ভারে তাকে ন্যুব্জ করার কোনই দরকার নেই- “for our modern minds, the problem of Where do we come from? What are we? Where are going? has been greatly clarified by the torch of reason alone. Let the fable and the legend continue as they are, of utmost beauty…; they have nothing to do with scientific reasoning.”
গোগাঁ চেয়েছিলেন, রূপকথা ও কিংবদন্তির সৌন্দর্য্য এবং ধাঁধার রহস্য তুলে ধরতে, এবং তিনি এতে খুব ভালভাবেই সফল হয়েছিলেন। কিন্তু আমরা যদি রূপকথা, কিংবদন্তি আর ধাঁধার চেয়ে নৈর্ব্যক্তিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ কোন উত্তর চাই তাহলে গোঁগার উপদেশ মেনেই উচিত হবে বৈজ্ঞানিক যুক্তির দিকে মুখ ফেরানো। গোগাঁ মহা বিস্ফোরণের (বিগ ব্যাং) মধ্য দিয়ে আমাদের মহাবিশ্বের যাত্রা শুরু, সেই বিশ্বে ছায়াপথ আর তারার উৎপত্তি, একটি তারার সঙ্গী হিসেবে জন্ম নেয়া পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই হয়তো জানতেন না, অন্তত যতোটা আমরা জানি তার তুলনায় কিছুই না। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব সম্পর্কে কতোটা ওয়াকিবহাল ছিলেন তাও আমরা জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, প্রাচীন গ্রিকরা যেমন মিথোস (পৌরাণিক কাহিনী) এবং লোগোসের (যৌক্তিক জ্ঞান) মধ্যে একটা পার্থক্যরেখা টানতে সমর্থ হয়েছিলেন তারই জয়গান গেয়েছেন গোগাঁ।
মিথোস বা রূপকথা একটি শিশুকে কেবল আনন্দ দেয় তাই না, সন্তুষ্টও করতে পারে। শিশু যখন মাকে প্রথম প্রশ্ন করে, আমি কোথা থেকে এসেছি, তখন মা যত আকর্ষণীয় উত্তর দেবে শিশুটির মনে তা ততো বেশি গেঁথে যাবে। মা যদি বলে, বাণের জলে কুড়িয়ে পেয়েছি তোকে, তখন হয়তো সে অতোটা সন্তুষ্ট হবে না, কিন্তু যদি বলা হয় ঈশ্বর তাকে নিজের ভাণ্ডারে রেখে দিয়েছিলেন সঠিক সময়ের অপেক্ষায়, সেই ভাণ্ডার থেকেই সে এসেছে তখন সে বেশ মজা পাবে, একটা বয়স পর্যন্ত পাল্টা কোন প্রশ্ন তাকে ভাবাবে না। কিন্তু যুক্তি বাঁধতে শেখার পর তার মনে আবারও অসংখ্য প্রশ্ন জাগে। বয়সের সাথে সাথে হয় সে প্রশ্ন করা বন্ধ করে নয়তো যৌক্তিক উত্তর পেতে চেষ্টা করে। মানুষের পুরো ইতিহাসকে একটি মানুষের জীবনের সাথে তুলনা করলে বলা যায়, সভ্যতার শিশুকালে পৌরাণিক কাহিনী আর গল্পগাঁথা মানুষকে সন্তুষ্ট করতো। কিন্তু গ্রিকরাই প্রথম অসন্তুষ্টির বীজ বপন করলো। মিথোসের সৌন্দর্য্যে আবেগতাড়িত হয়েও পেতে চাইলো লোগোসের প্রশান্তি।
তবে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, গণিত, দর্শন ও সমাজতত্ত্বে লোগোস খুব ভালভাবে প্রয়োগ করলেও একমাত্র আনাক্সিমান্দ্রোস ছাড়া প্রাচীন গ্রিসের আর কেউ মহাবিশ্ব ও মানুষের জন্মকাহিনী জানতে লোগোস খুব একটা প্রয়োগ করেননি। জার্মানির ট্যুবিঙেনে অবস্থিত মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজির এক সময়কার পরিচালক অধ্যাপক ইয়ান ক্লাইনের মতে এর কারণ মূলত দুটি- প্রথমত, পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষণের দিকে তাদের খুব একটা আগ্রহ ছিল না, তারা বরং ঘরে আয়েশে বসে চিন্তা করা বা আড্ডাশালায় বসে ধীরস্থির বিতর্কে বিশ্বাস করতেন। দ্বিতীয়ত, ধর্ম; মানুষের উৎপত্তি নিয়ে কথা বলার অধিকার যে যুগে যুগে নিজের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম এই উৎপত্তির কাহিনীকে আক্ষরিক অর্থেই সত্যি মেনে নিতে বাধ্য করেছে মানুষকে, দ্বিমত করলে দেখিয়েছে প্রাণ নাশের হুমকি। কিন্তু উনবিংশ শতকে ইউরোপে ধর্মের প্রভাব অনেকটা কমে যাওয়ার পর মানুষের উৎপত্তির প্রশ্নে লোগোস প্রয়োগ করা হয়েছে। গ্রিকদের লোগোস থেকে জন্ম হয় প্রাকৃতিক দর্শনের যা থেকে আসে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। বর্তমানে এই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মাধ্যমেই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম আমরা। সত্যি বলতে, বর্তমানে এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করার একমাত্র অধিকার প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের।
সব শুরু হয়েছিল স্থানকালের একটি মহা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে
বর্তমান প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বলে, আজ থেকে প্রায় ১৩৭০ কোটি বছর পূর্বে স্থানকালের একটি মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের এই মহাবিশ্বের। বিস্ফোরণের মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে মহাবিশ্বের প্রাথমিক সব গাঠনিক উপাদান তথা ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ও ফোটন তৈরি হয়ে যায়। প্রোটন ও নিউট্রন মিলে গঠন করে প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস। ফোটন এবং ইলেকট্রন নিজেরা নিজেরা যেন এক চুক্তি করে বসে, তারা একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করবে, অন্য কারও সাথে কভু মিলবে না। বিস্ফোরণের ৩ লক্ষ ৮০ হাজার বছর পর অবশ্য নিউক্লিয়াসগুলো ফোটনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় সব ইলেকট্রনকে, তাদের আবদ্ধ করে গভীর বন্ধনে, জন্ম হয় নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণুর (অন্যান্য পদার্থ যেমন লিথিয়ামের পরিমাণ ছিল খুব নগণ্য)। মুক্ত ইলেকট্রন না পেয়ে ফোটনগুলো এবার মহাশূন্যব্যাপী তাদের নিঃসঙ্গ অভিযাত্রা শুরু করে। সেসব ফোটন আজ আমরা সনাক্ত করে পারি, এরাই মহাবিশ্বের সে সময়টা সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায়।
বিস্ফোরণের ধাক্কায় মহাবিশ্ব প্রসারিত ও ঠাণ্ডা হতেই থাকে। তখন হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও লিথিয়ামের মত হালকা মৌল ছাড়া অন্য কোন মৌল ছিল না। আর ফোটন বলতে ছিল কেবল সেই নিঃসঙ্গ যাত্রীরা। বিস্ফোরণের আনুমানিক ৩০-৪০ কোটি বছর পর মহাবিশ্বের যেসব অঞ্চলে পদার্থের ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল সেখানে সম্প্রসারণের বহির্মুখী বলের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয় মহাকর্ষের অন্তর্মুখী বল। এ কারণে সে অঞ্চলগুলো নিজের ভরে কেন্দ্রের দিকে চুপসে যেতে থাকে। এভাবেই জন্ম হয় প্রথম ছায়াপথ ও ছায়াপথ স্তবকের। একটি ছায়াপথের ভেতর আবার অসংখ্য ছোট ছোট অঞ্চলে পদার্থের (প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম) ঘনত্ব পরিপার্শ্বের তুলনায় বেশি হওয়ায় সেগুলোও চুপসে যেতে শুরু করে। গঠিত হয় প্রথম যুগের তারারা। একেকটি ছায়াপথের ভেতর তারা থাকে প্রায় ১০০০ কোটি। তারার পেটের ভেতরেই প্রথম বারের মত হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌলিক পদার্থগুলো নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়। তারাটির মৃত্যুর পর একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে সে এসব ভারী পদার্থ মহাশূন্যে ছড়িয়ে দেয়।
পরবর্তী যুগগুলোতে তাই তারার বাইরে তথা মহাশূন্যের কিছু অঞ্চলেও হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌলের উপস্থিতি দেখা যায়। আমাদের ছায়াপথের নাম আকাশগঙ্গা, তার বয়স ১৩২০ কোটি বছর, অর্থাৎ মহা বিস্ফোরণের আনুমানিক ৫০ কোটি বছর পরই তার জন্ম হয়েছিল। যথারীতি তার ভেতরেও সৃষ্টি হয় অসংখ্য তারার যাদের অনেকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে। সেযুগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তারার মৃত্যুর পর আকাশগঙ্গার বিভিন্ন স্থানে বিশাল বিশাল সব আণবিক মেঘের অস্তিত্ব দেখা যায়। এসব মেঘের ভেতর পদার্থের ঘনত্ব পরিপার্শ্বের চেয়ে অনেক বেশি, এবং এদের ভেতর হিলিয়ামের চেয়ে ভারী অনেক মৌলই ছিল। এসব মেঘের ভর যখন একটি নির্দিষ্ট ভরের (জিন্স ভর) বেশি হয়ে যায় তখন সে একইভাবে নিজের কেন্দ্রের দিকে চুপসে যেতে শুরু করে। এমনই একটি আণবিক মেঘের সংকোচনের মাধ্যমে আজ থেকে প্রায় ৪৫৭ কোটি বছর পূর্বে তথা মহা বিস্ফোরণের প্রায় ৯১৩ কোটি বছর পর জন্ম হয়েছিল আমাদের সূর্যের।
তবে মেঘের সকল পদার্থই সূর্যের ভেতর চলে গেছে ব্যাপারটা এমন নয়। মেঘ সংকুচিত হতে হতে কেন্দ্রে একটি অতিঘন প্রোটোস্টার বা প্রাক-তারা এবং প্রাক-তারাটির চারদিকে একটি ঘূর্ণনশীল চাকতি গঠন করেছিল। এই চাকতিতে অনেক ভারী ভারী মৌল ছিল যাদের থেকে জন্ম হয়েছে আমাদের সৌরজগতের সবগুলো গ্রহের। চাকতি থেকে পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল আনুমানিক ৪৫৪ কোটি বছর পূর্বে অর্থাৎ সূর্য গঠনের তিন কোটি বছর পর। গ্রহের গঠনও আসলে অনেকটা মহাকর্ষের প্রভাবে পদার্থের একীভূত হওয়ার ফলাফল। আশাপাশের সব পদার্থকে নিজের মধ্যে পুরে নিতে পৃথিবীর ১-২ কোটি বছরের বেশি সময় লাগেনি। পৃথিবীর উপরিভাগটা প্রথমে প্রচণ্ড উত্তাপে গলিত অবস্থায় ছিল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই শীতলীকরণের মাধ্যমে একটি কঠিন ভূত্বক এবং একটি উপগ্রহ গঠিত হয় যাকে আমরা বলি চাঁদ। অনেকে মনে করেন, গ্রহ আকৃতির আরেকটি বিশাল পিণ্ড পৃথিবীকে আঘাত করেছিল বলেই জন্মেছিল চাঁদ।
এরপরে বড় ধরণের পরিবর্তন ছিল বায়ুমণ্ডল গঠন। আদি বায়ুমণ্ডল গঠিত হয়েছিল পৃথিবীর ভেতর থেকে বের হতে থাকা গ্যাস ও অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে। পাশাপাশি জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে জন্ম দিয়েছিল মহাসমুদ্রের। মহাদেশ আর মহাসাগরের পৃথিবীতে ভৌগলিক বিবর্তন কখনোই থেমে থাকেনি। প্রতিনিয়ত এসেছে পরিবর্তন যদিও একেকটি পরিবর্তনের সময়কাল আমাদের জীবনের সাপেক্ষে অনেক দীর্ঘ।
৪০০ কোটি বছর পূর্বে এই পৃথিবীতে জটিল রাসায়নিক পদার্থের বিবর্তনের মাধ্যমে প্রথম এমন একটি জৈব অণু গঠিত হয়েছিল যা নিজেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে পারে। এরপর প্রায় ৫০ কোটি বছরে প্রাণের বড় কোন বিবর্তন ঘটেনি। ধরে নেয়া যায় পৃথিবীর সকল জীবের আদি পূর্বপুরুষ অর্থাৎ প্রথম প্রাণ পৃথিবীতে বিচরণ করছিল ৪০০ থেকে ৩৫০ কোটি বছর পূর্বে। একসময় এমন কিছু জীবের জন্ম হয় যারা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে সূর্যের আলো থেকে খাবার তৈরি করতে পারে, বিনিময়ে বায়ুমণ্ডলে ফিরিয়ে দেয় অক্সিজেন। এভাবেই দিন দিন অক্সিজেন সমৃদ্ধ হতে থাকে পৃথিবী, ওজোনের একটি স্তরও গঠিত হয় যা সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি আটকে দিয়ে পৃথিবীতে প্রাণ বিকাশের সুযোগ করে দেয়। এককোষী থেকে বহুকোষী এভাবে প্রতিনিয়ত জটিল থেকে জটিলতর প্রাণে ভরে ওঠে পৃথিবী।
আনুমানিক ৭৫ থেকে ৫৮ কোটি বছর পূর্বের সময়টাতে সমগ্র পৃথিবী তুষারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, তখনকার পৃথিবীটাকে তাই বলা হয় স্নোবল পৃথিবী। এর পরই প্রায় ৫৩ কোটি বছর পূর্বে ঘটে বৈপ্লবিক ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ, কোন স্থানকালের নয় বরং এটি ছিল পৃথিবীতে বহুকোষীয় প্রাণের বিস্ফোরণ। খুব কম সময়ে বহুকোষী জীব সংখ্যা ও বৈচিত্র্যে অনেক বেড়ে যায়। তবে তাদের সুখ বেশিকাল সয়নি, গত ৫৩ কোটি বছরে পৃথিবীতে অন্তত পাঁচটি বড় বড় গণবিলুপ্তি ঘটেছে। অর্থাৎ অন্তত পাঁচ বার জীবকূল প্রায় পুরোপুরি বিলুপ্ত হতে বসেছিল। ৪৪ কোটি বছর পূর্বে এ ধরণের প্রথম বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে। এরপর ৩৭ কোটি বছর পূর্বে ঘটে দ্বিতীয়টি। সবচেয়ে বড় বিলুপ্তিটি ঘটেছিল ২৫ কোটি ১০ লক্ষ বছর আগে যার নাম পার্মিয়ান-ট্রায়াসিক গণবিলুপ্তি। সে সময় জলভাগের শতকরা ৯০ ভাগ এবং স্থলভাগের শতকরা ৭০ ভাগ জীব নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল; উদ্ভিদ, প্রাণী বা পোকামাকড় কেউই সে কড়াল থাবা থেকে রেহাই পায়নি। এরপর আবার বিশ্বব্যাপী মৃত্যুযজ্ঞ ঘটে ২০ কোটি ১০ লক্ষ বছর পূর্বে, নাম ট্রায়াসিক-জুরাসিক গণবিলুপ্তি। আর সব শেষে ৬.৫ কোটি বছর পূর্বের গণবিলুপ্তির করুণ শিকার হয় স্থলচর ডাইনোসররা। এই বিলুপ্তির নাম যথারীতি ক্রিটাশিয়াস-টার্শিয়ারি গণবিলুপ্তি কারণ তার ঠিক আগের যুগটির নাম ক্রিটাশিয়াস আর পরেরটির টার্শিয়ারি (যদিও একালের বিজ্ঞানীরা টার্শিয়ারির বদলে প্যালিওজিন ব্যবহার করেন)। সংক্ষেপে একে ডাকা হয় কে/টি গণবিলুপ্তি নামে। কে/টি বিলুপ্তি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। কারণ ডাইনোসরদের মহাত্রাস থেকে মুক্তির পরই স্তন্যপায়ী প্রাণীরা বিকশিত হতে শুরু করেছিল যে স্তন্যপায়ীদের উত্তরসূরী আমরা।

জুরাসিক পার্কের ইতিবৃত্ত
১৯৯৩ সালে মার্কিন চলচ্চিত্রকার স্টিভেন স্পিলবার্গ নির্মাণ করেন জুরাসিক পার্ক সিনেমাটি। ৯০-এর দশকের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমাগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত এই সিনেমার প্রধান এবং হয়তো একমাত্র অনন্য অর্জন ছিল সিম্যুলেশনের মাধ্যমে বড় পর্দায় ডাইনোসরদের জীবন্ত করে তোলা। এই ডাইনোসররা বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেছিল জুরাসিক যুগে যে যুগ আজ থেকে প্রায় ২০ কোটি বছর পূর্বে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল সাড়ে চৌদ্দ কোটি বছর পূর্বে। ডাইনোসরদের ফসিলে পাওয়া ডিএনএ থেকে একটা আস্ত ডাইনোসর বানিয়ে ফেলাটা বাস্তবে যতোই অসম্ভব হোক না কেন কল্পবিজ্ঞানে মোটেই অসাধ্য কিছু নয়। সিনেমায় ঠিক তাই করা হয়েছে। ২০ কোটি বছর আগে ডাইনোসরদের সফল সূচনা এবং সাড়ে ছয় কোটি বছর পূর্বে স্থলচর ডাইনোসরদের পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া- এগুলো না হলে আধুনিক মানুষের বিবর্তন হোত কিনা সন্দেহ আছে, আর সেটা না হলে স্পিলবার্গ তার সিনেমাটা যে বানাতে পারতেন না তা বলাই বাহুল্য।
ডাইনোসরদের যুগেও স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল কিন্তু তাদের অবস্থা খুব একটা সুবিধার ছিল না। অধিকাংশই ছিল ইঁদুর বা ছুঁচোর মত ছোট আকারের নিশাচর কীটভূক প্রাণী। প্রায় ১০ কোটি বছর সরীসৃপদের দাপটে তাদের দেখা পাওয়াই ছিল ভার। কে/টি বিলুপ্তি পরিস্থিতি হঠাৎ করেই অনেক পাল্টে দেয়। এই সুযোগে খুব কম সময়ের মধ্যেই তাদের অসংখ্য প্রজাতিতে পৃথিবী ছেয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গণবিলুপ্তিটি কিভাবে ঘটেছিল?
বিষয়টি বিতর্কিত। প্রায় দুই শতাব্দী আগে যখন প্রথম গণবিলুপ্তির খবর পাওয়া যায় তখন বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং শিকার, প্রতিযোগিতা ও রোগ-শোকের মত জৈব প্রভাবের কারণে ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবেই এটি ঘটে। কিন্তু ১৯৮০ সালে “ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলির” বিজ্ঞানী ওয়াল্টার আলভারেজের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি বিজ্ঞানী দলের গবেষণা বলে অন্য কথা। তারা বুঝতে পারেন ৬.৫ কোটি বছর পূর্বে মহাশূন্য থেকে আগত গ্রহাণুর আঘাতে সৃষ্ট বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয়ের কারণে ডাইনোসররা অনেকটা হঠাৎ করেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী দুই দশক ধরে এই ধারণা ব্যাপক প্রসার লাভ করে। উদ্বুদ্ধ হয়ে আরও অনেক বিজ্ঞানী গবেষণায় যোগ দেন এবং আরও তিনটি গণবিলুপ্তির কারণ হিসেবে বহির্জাগতিক বস্তুর আঘাতকে দায়ী করা হয়। হলিউডের “ডিপ ইমপ্যাক্ট” ও “আর্মাগেডন” এর মত ব্লকবাস্টার সিনেমার মাধ্যমে সাধারণ্যেও ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সুতরাং বলাই যায়, আলভারেজ গণবিলুপ্তি গবেষণার ইতিহাসে নতুন একটি যুগ শুরু করেছিলেন।
নতুন যুগের পত্তনে অবশ্য তিন জনের অবদান সবচেয়ে বেশি- ওয়াল্টার আলভারেজ, তার বাবা পদার্থবিজ্ঞানী লুই ডব্লিউ আলভারেজ এবং নিউক্লীয় রসায়নবিদ হেলেন ভি মিচেল। তাদের প্রস্তাব ছিল মূলত দুটি: এক, প্রায় ১০ কিলোমিটার ব্যাসের একটি বিশাল গ্রহাণু ৬.৫ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল; দ্বিতীয়ত এই সংঘর্ষের পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবীর অর্ধেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্যই প্রমাণ ছাড়া কথা বলেননি তারা। পার্থিব বস্তুতে ইরিডিয়ামের পরিমাণ খুব কম থাকে কিন্তু বহির্জাগতিক বস্তুতে তার আধিক্য দেখা যায়। গ্রহাণুর সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীতে ইরিডিয়ামের যে ধূলিময় আভার সৃষ্টি হয়েছিল তার নিদর্শনই খুঁজে পাওয়া গেছে।
এরপর এমনকি ঘাতক গ্রহাণুর পদচিহ্নও আবিষ্কৃত হয়। মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপের একটি ছোট্ট শহরের নাম চিকশুলুব। শহরটির খুব কাছে মাটির অনেক নিচে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর বৃহত্তম খাদগুলোর একটি। গ্রহাণুর আঘাতেই সাড়ে ছয় কোটি বছর পূর্বে এই খাদের জন্ম হয়েছিল। ইরিডিয়ামের স্তর এবং চিকশুলুব খাদ আবিষ্কারের পর ডাইনোসরদের আকস্মিক বিলুপ্তি নিয়ে সব সন্দেহই কেটে গিয়েছিল। এমনকি অনেকে ভাবতে শুরু করেন সকল যুগেই গণবিলুপ্তির প্রধান কারণ বহির্জাগতিক বস্তুর আঘাত। পাঁচটির মধ্যে শেষ চারটির কারণ হিসেবেই গ্রহাণুর সংঘর্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আর প্রথম গণবিলুপ্তির কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় নিকটবর্তী কোন তারার বিস্ফোরণ।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আরও উন্নত পরীক্ষা আবারও এই অনুকল্পের ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে। বিলুপ্তির হার পরীক্ষার একটি শক্তিশালী পদ্ধতি কার্বন সমাণুর রেকর্ড পর্যবেক্ষণ। কার্বনের তিনটি সমাণু আছে যাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য নিউক্লিয়াসে নিষ্ক্রিয় নিউট্রনের সংখ্যা। তিনটির মধ্যে কার্বন-১৪ নামক সমাণুটির সাথে আমরা কমবেশী সবাই পরিচিত। কারণ, এই সমাণু দিয়ে জীবাশ্ম বা প্রাচীন পাললিক শিলার বয়স নির্ণয় করা হয়। কিন্তু গণবিলুপ্তি ব্যাখ্যার জন্য এর চেয়েও ভাল একটি পদ্ধতি পাওয়া গেছে, আর তা হল কোন ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডে উপস্থিত কার্বন-১৩ এবং কার্বন-১২ সমাণু দুটির পরিমাণের অনুপাত। এই অনুপাতের মাধ্যমে বয়স তো নির্ণয় করা যায়ই, সেই সাথে ঐ সময় নির্দিষ্ট উদ্ভিদ প্রজাতির বিস্তৃতি কতটা ছিল তাও বের করা যায়।
কারণ, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া পরিবেশে কার্বন-১২ ও কার্বন-১৩ ‘র অনুপাত পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রাখে। উদ্ভিদেরা পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে তা থেকে জৈব কার্বন ও শক্তি উৎপাদন করে। এর মাধ্যমেই বেঁচে থাকে তারা। সৌভাগ্য আমাদের, প্রাণীদের এতো কষ্ট করতে হয়না, উদ্ভিদের আবর্জনা খেয়েই আমরা বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু, আসল ব্যাপার হল, প্রাণীরা কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে গিয়ে পক্ষপাতিত্ব করে। তারা সেই কার্বন ডাই অক্সাইডই শোষণ করে যার মধ্যে কার্বন-১২ আছে, অন্যগুলো সহজে নিতে চায়না- তা সে সমুদ্রে ভাসমান খুদেকায় প্ল্যাংকটনই হোক আর বিশাল বৃক্ষই হোক। সুতরাং, যখন পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিদ থাকে তখন পরিবেশে কার্বন-১৩ ‘র পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়, ফলে বেড়ে যায় কার্বন ১৩-১২ অনুপাতও।
গণবিলুপ্তির আগে, গণবিলুপ্তির সময় এবং বিলুপ্তির পরে এই দুটি সমাণুর পরিমাণ নির্ণয় করে তা থেকে অনুপাত বের করা হয়। আর এভাবেই গবেষকরা জলে ও স্থলে সে সময় কি পরিমাণ উদ্ভিদ ছিল তা বের করে ফেলতে পারেন। উপাত্ত সংগ্রহের পর গবেষকরা অনুভূমিক অক্ষে সময় আর উল্লম্ব অক্ষে কার্বন-১৩ ‘র আনুপাতিক পরিমাণ বসিয়ে লেখ অংকন করেন। কে/টি বিলুপ্তির এমন লেখচিত্রে দেখা গেল, কার্বন-১৩ ‘র পরিমাণ হঠাৎ করে একেবারে কমে গেছে এবং পরে আবার বেড়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, সে সময় সংঘর্ষের কারণে উদ্ভিদ প্রজাতির বিশাল অংশ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং পরে আবার ফিরে এসেছে। স্থলভাগের বড় বড় গাছ এবং জলভাগের ছোট ছোট প্ল্যাংকটন সবার জন্যই এটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

তিনটি
গণবিলুপ্তির সময় কার্বন-১৩ 'র সাথে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের আদর্শ পরিমাণের
অনুপাত দেখানো হয়েছে এখানে। ০-দ্বারা দুটির পরিমাণ সমান বোঝায়। আর যত
ঋণাত্মকের দিকে যেতে থাকে কার্বন-১৩ 'র পরিমাণ ততো কমে। অর্থাৎ উপরের দিকে
কার্বন-১৩ কমছে আর নিচের দিকে বাড়ছে।
অনেকে মিলে এই গুরুত্বপূর্ণ বিলুপ্তি ঘটনাগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন। কিন্তু কেউ এখন পর্যন্ত এমন কোন কার্বন অণুর সন্ধান পায়নি যাতে বহির্জাগতিক গ্যাস আটকা পড়ে আছে। সে সময়ের একটি আঘাতপ্রাপ্ত কোয়ার্জের সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু, অস্ট্রেলিয়ার নিকটবর্তী সমুদ্রতলে ও অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে প্রাপ্ত এই কোয়ার্জ খাদগুলো আসলেই সংঘর্ষ খাদ নাকি নিছক প্রাকৃতিক খাদ তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ৪র্থ গণবিলুপ্তির সময়কার যে ইরিডিয়াম স্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে তার পরিমাণ এতো কম যে তা মোটেই গণবিলুপ্তির জন্য যথেষ্ট নয়। কে/টি বিলুপ্তির মত বহির্জাগতিক বস্তুর সংঘর্ষ যদি আগের বিলুপ্তিগুলো না ঘটিয়ে থাকে, তবে এর প্রকৃত কারণ কি? নতুন গবেষণা বিজ্ঞানীদের বলছে, পৃথিবী নিজেই শত্রুতা করে তার অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে এবং হয়তো তা-ই সে করেছিল।
তবে আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষদের বিবর্তন বোঝার জন্য তাৎক্ষণিক বিলুপ্তি বনাম ধীর বিলুপ্তির বিতর্কের আরও গভীরে না গেলেও চলবে। কারণ সর্বশেষ গণবিলুপ্তির পেছনে মুখ্য ভূমিকা যে বহির্জাগতিক গ্রহাণুটিরই ছিল এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। পৃথিবী সম্পূর্ণ জাগতিক উপায়েও প্রাণের জন্য প্রতিকূল হয়ে উঠতে পারে আবার বহির্জাগতিক কোন অনুপ্রবেশকারীও অনুকূল বসুন্ধরাকে প্রাণের জন্য বিরূপ করে দিতে পারে। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে ৬.৫ কোটি বছর পূর্বে যে অনুপ্রবেশকারী ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ঘটিয়ে মানুষের পূর্বপুরুষদের বিবর্তনের পথ সহজ করে দিয়েছিল তার প্রতিদান দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে কিনা তা বলা দুষ্কর। কারণ এই আমাদের কারণেই বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে, আমরা নিজেরাই এখন পৃথিবীকে প্রাণের জন্য প্রতিকূল করে দিচ্ছি।
তাই ভবিষ্যতে জীবকূলকে টিকিয়ে রাখতে হলে বর্তমানে যেমন পরিবেশ সংরক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে তেমনি ভবিষ্যৎ দুর্যোগের জন্যও নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। কারণ সৌরজগতে গ্রহাণুর কোন অভাব নেই। মঙ্গল এবং বৃহস্পতি গ্রহের মাঝে অসংখ্য গ্রহাণুর একটি বেষ্টনী আছে। ছোট ছোট গ্রহাণুর পৃথিবীর দিকে ধাবিত হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। পৃথিবীর সাপেক্ষে তাদের বেগও অনেক বেশি। কিন্তু ভাগ্য ভাল যে এদের অধিকাংশই খুব ছোট, বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর অনেকগুলো আবার প্রচণ্ড তাপ ও চাপে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এসব টুকরোর ভূপৃষ্ঠে পতনকেই আমরা উল্কাপাত বলি। কিন্তু কয়েক কোটি বছরে একবার বিশাল বড় কোন গ্রহাণুও চলে আসতে পারে আমাদের দিকে। আর তখনই বিপদ। প্রচণ্ড বেগের কারণে ভূপৃষ্ঠের সাথে সংঘর্ষের পর তারা অভাবনীয় পরিমাণ শক্তির উদ্ভব ঘটায়। বুলেটের ক্ষত গরম থাকে যার কারণ বুলেটের উচ্চ বেগ। চিকশুলুব খাদ সৃষ্টিকারী গ্রহাণুর বেগ বুলেটের চেয়েও বেশি ছিল এবং তার ভর ছিল কয়েক বিলিয়ন টন।
ঘণ্টায় কয়েক হাজার মাইল বেগে ধাবমান সেই গ্রহাণু ভূপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ার পর যে শব্দ হয়েছিল তার তীব্রতা আমরা ভাবতেও পারি না। হয়ত অধিকাংশ প্রাণী সেই শব্দে চিরতরে বধির হয়ে গিয়েছিল। বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট আগুনের হাত থেকে যারা রেহাই পেয়েছিল তাদেরকে হয় বাতাসের প্রাণনাশী ঝাপ্টার সম্মুখীন হতে হয়েছে নয়তো ১৫০ মিটার উঁচু সুনামিতে ডুবে মরতে হয়েছে। এর পাশাপাশি আবার ছিল প্রচণ্ড তীব্রতার ভূমিকম্প। এ তো গেল কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার কথা। সংঘর্ষের পরিণামও কোন অংশে কম ভয়ানক ছিল না। সকল বনভূমিতে আগুন লেগে গিয়েছিল, ছাইভস্ম আর ধূলিতে আকাশ এতোটাই ঢেকে গিয়েছিল যে প্রায় দুই বছর সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারেনি। এতে অধিকাংশ উদ্ভিদ মরে গিয়ে পৃথিবীর খাদ্যচক্র থামিয়ে দিয়েছিল।
এমন বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই। এটা সত্যি যে, আমাদের জীবদ্দশায় এদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম, কিন্তু ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে পারি বলেই তো আমরা মানুষ। সত্যি বলতে, পৃথিবীর দিকে স্টার ট্রেকের ভাষায় কলিশন কোর্সে রত কোন গ্রহাণুকে ঠেকানোর উপায় আমাদের জানা আছে, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে। আজ থেকে কয়েক দশক আগের পরিকল্পনা ছিল এমন কিছু হলে মানব সভ্যতার সকল জ্ঞান কম্পিউটারে পুরে ভূগর্ভে রেখে দেয়া হবে, সাথে রাখা হবে কিছু নির্বাচিত মানুষকে। বিজ্ঞানকে ধন্যবাদ যে এসব বিশেষ মানুষ নির্বাচনের মত অসম্ভব কাজ আমাদেরকে আর করতে হবে না। কৃত্রিম উপগ্রহে করে কোন শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা পাঠিয়ে দেয়া হবে গ্রহাণু-পৃষ্ঠে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য। বিস্ফোরণে গ্রহাণু পূর্বের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। তবে এতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও থেকে যায়। তাই সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে মহাকর্ষীয় ট্রাক্টর- গ্রহাণুকে আবর্তনরত একটি কৃত্রিম উপগ্রহ যা মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে একটু একটু করে গ্রহাণুটিকে আগের কক্ষপথ থেকে সরিয়ে আনবে।
তাহলে বলা যায়, আমাদেরকে ধ্বংস করতে প্রকৃতির বেশ কষ্টই হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরাও কিন্তু আমাদের মতোই সফল ছিল। আমাদের অস্তিত্ব আছে তার অর্থই হচ্ছে আমাদের পূর্বপুরুষরা পাঁচ পাঁচটি বড় গণবিলুপ্তির পরও টিকে ছিলে। কখনো কখনো বধির আর অন্ধ হয়ে গেলেও কেবল প্রজনন শক্তিটি ধরে রেখেছে তারা। হয়তো বিলুপ্তির সময় নিরাপদ আশ্রয়ে ঘুমিয়ে ছিল, আর দুর্যোগ শেষে নতুন পরিবেশের শতকরা একশ ভাগ সদ্ব্যবহার করেছে। সেই সব পূর্বপুরুষদের বিস্তারিত বর্ণনায় আমরা যাব না। কিন্তু শেষ তথা কে/টি বিলুপ্তির সময় আমাদের যে পূর্বপুরুষরা টিকে ছিল তাদের বিবর্তন সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়।
ইতিমধ্যেই বলেছি, ক্রিটাশিয়াস যুগে সরীসৃপ তথা ডাইনোসরদের দাপটে স্তন্যপায়ীরা মিইয়ে থাকতো, কিন্তু কে/টি বিলুপ্তির পর ডাইনোসরবিহীন পৃথিবী পেয়ে এরা পুরো পৃথিবী ছেয়ে ফেলে। এই বেঁচে যাওয়া স্তন্যপায়ীদের মাঝে আমাদের প্রাইমেট পূর্বপুরুষরাও ছিল কিনা সে নিয়ে বিতর্ক আছে। বর্তমান প্রাইমেটদের ডিএনএ পরীক্ষা করে জানা গেছে প্রাণবৃক্ষের প্রাইমেট শাখাটির উদ্ভব আজ থেকে প্রায় ৮.৫ কোটি বছর পূর্বে। এটা সত্যি হলে কে/টি বিলুপ্তির আগেই প্রাইমেটদের অস্তিত্ব ছিল এবং তারা বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু প্রাচীনতম প্রাইমেট ফসিলটি ৫.৫ থেকে ৫.৮ কোটি বছর পূর্বের। আমি এখানে ধরে নিচ্ছি, কে/টি বিলুপ্তির পরই প্রাইমেটদের উদ্ভব ঘটেছে, কেবল এই জন্য যে অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এমনটি ধরে নেন। তবে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, অনেকে মনে করেন ডাইনোসরদের যুগেই প্রাইমেটদের অস্তিত্ব ছিল।
প্রাইমেটদের বিবর্তন
কে/টি বিলুপ্তি থেকে বেঁচে যাওয়া স্তন্যপায়ীদের দিয়েই প্রাইমেট বিবর্তনের কাহিনী শুরু করা যুক্তিযুক্ত। ঠিক কতগুলো স্তন্যপায়ী প্রজাতি বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং তাদের সাথে মানুষের সম্পর্ক কতটুকু এ নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। বর্তমানে এ বিষয়ক অন্তত তিনটি মডেল আছে যা রিচার্ড ডকিন্স তার “দি অ্যানসেস্টরস টেইল” বইয়ে উল্লেখ করেছেন:
১। মহা বিস্ফোরণ মডেল: এটা স্থানকালের মহা বিস্ফোরণও নয় আবার ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণও নয় তবে ক্যামব্রিয়ানের একটু কাছাকাছি। কারণ এটাও প্রজাতির বিস্ফোরণ। এতে বলা হয়, কেবল একটি স্তন্যপায়ী প্রজাতি কে/টি বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেয়েছিল। একটি প্রজাতি থেকে খুব কম সময়ে অনেক প্রজাতি হতে হলে ঠিক মহা বিস্ফোরণই প্রয়োজন। এই মডেল অনুসারে প্রাণবৃক্ষে সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীর শাখা কে/টি বিলুপ্তির পরে একসাথে মিলিত হয়।
২। বিলম্বিত বিস্ফোরণ মডেল: এই মডেলও মনে করে কে/টি বিলুপ্তির পর স্তন্যপায়ী প্রাণীর সংখ্যায় বিস্ফোরণ ঘটেছিল, কিন্তু বিলুপ্তি থেকে কেবল একটি প্রজাতি রক্ষা পায়নি, অনেকগুলো রক্ষা পেয়েছে। প্রাণবৃক্ষে সকল স্তন্যপায়ীর শাখাগুলো একটি শাখায় মিলিত হয় কে/টি বিলুপ্তিরও আগে, সেই ক্রিটাশিয়াস যুগে। ডাইনোসররা প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চ থেকে চলে যাওয়ার পর ছুঁচোর মত বেশকিছু প্রজাতি বেঁচে ছিল এবং সুযোগ পেয়ে তাদের একেকটি থেকে একেক ধরণের স্তন্যপায়ীর জন্ম হয়েছে। একটি প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়েছে মাংসাশী স্তন্যপায়ীরা, আরেকটি থেকে প্রাইমেট। বেঁচে থাকা সবগুলো ছুঁচো প্রজাতি প্রায় কাছাকাছি ধরণের হলেও তাদের সবার সাধারণ পূর্বপুরুষ বাস করতো ডাইনোসরদের যুগে। এখন থেকে আমরা সাধারণ পূর্বপুরুষকে ইংরেজি অনুসরণ করে কনসেস্টর (common+ancestor=concestor) ডাকব।
৩। বিস্ফোরণহীন মডেল: কে/টি বিলুপ্তি স্তন্যপায়ীদের বিবর্তনের ইতিহাসে বড় কোন যুগসন্ধিক্ষণ নয়। অর্থাৎ এ সময় স্তন্যপায়ী বিবর্তনের ইতিহাসে কোন ছন্দপতনই ঘটেনি। এই মডেল অনুসারেও আমাদের সবার পূর্বপুরুষরা ডাইনোসরদের যুগেই বাস করতো, এবং সে যুগেই প্রাইমেট সহ আরও বেশ কিছু প্রজাতি বিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মডেল হচ্ছে দ্বিতীয়টি। এটা সত্যি যে, স্তন্যপায়ীদের পূর্বপুরুষরা ডাইনোসরদের যুগেও ছিল, কিন্তু তখন তাদের খুব বেশি বৈচিত্র্য ছিল না। ডাইনোসরদের বিলুপ্তির পরই কেবল তাদের পার্থক্য বাড়তে শুরু করেছে, অর্থাৎ প্রাণবৃক্ষের শাখাগুলোতে আরও প্রশাখা গজিয়ে উঠতে শুরু করেছে। আনুমানিক ১০.৫ কোটি বছর পূর্বে সকল স্তন্যপায়ীদের কনসেস্টর বাস করতো। এরপর ৪ কোটি বছরে তাদের থেকে কয়েকটি প্রজাতির উদ্ভব ঘটলেও তারা একে অপরের থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। ৬.৫ কোটি বছর পূর্বে পার্থক্যগুলো হু হু করে বাড়তে শুরু করে। অল্প সময়ে বৈচিত্র্য এত বেড়ে যাওয়ার একটা গালভরা নামও আছে: অ্যাডাপ্টিভ রেডিয়েশন বা অভিযোজনীয় বিকিরণ।
গত সাড়ে ছয় কোটি বছরে প্রাইমেটদের বিবর্তন বুঝতে হলে ভৌগলিক সময়-স্কেলের সাথে পরিচয় থাকাটা জরুরী। কে/টি বিলুপ্তির আগের Era-র নাম মেসোজোয়িক, আর পরেরটির নাম সেনোজোয়িক। মেসোজোয়িক এরাকে তিনটি পিরিয়ডে ভাগ করা হয়: ট্রায়াসিক, জুরাসিক ও ক্রিটাশিয়াস। সেনোজোয়িক এরাকে আগে দুটি পিরিয়ডে ভাগ করা হতো: টার্শিয়ারি (৬.৫ কোটি থেকে ২০ লক্ষ বছর) ও কোয়াটার্নারি (২০ লক্ষ বছর পূর্ব থেকে বর্তমান)। তবে বর্তমানে একে ভাগ করা হয় তিনটি পিরিয়ডে: প্যালিওজিন (৬.৫ থেকে ২.৩ কোটি), নিওজিন (২.৩ কোটি থেকে ২৫ লক্ষ বছর) ও কোয়াটার্নারি (২৫ লক্ষ বছর পূর্ব থেকে বর্তমান)। প্যালিওজিন পিরিয়ডে আবার আছে তিনটি ইপক প্যালিওসিন, ইউসিন এবং অলিগোসিন। একইভাবে নিউজিন পিরিয়ডের দুটি ইপক হচ্ছে মায়োসিন ও প্লায়োসিন আর কোয়াটার্নারি পিরিয়ডের দুটি ইপক প্লাইস্টোসিন ও হলোসিন। নিচের টেবিলে সবগুলো ইপকের সময়সীমা উল্লেখ করা আছে।


মেসোজোয়িক এরার শেষদিকেই প্রাইমেট বৈশিষ্ট্যের বিবর্তন শুরু হয়েছিল। সে সময় পৃথিবীর রূপ ছিল বর্তমান থেকে অনেক আলাদা। মহাদেশগুলো বর্তমান অবস্থানে ছিল না, তাদের আকৃতিও ছিল বেশ ভিন্ন। উত্তর আমেরিকা তখনও ইউরোপের সাথে যুক্ত কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার সাথে নয়। ভারত তখনও এশিয়ার সাথে মেলেনি তবে তার দিকে এগোচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকা ছিল অ্যান্টার্কটিকার খুব কাছে। অধিকাংশ স্থলভূমিতেই উষ্ণ ক্রান্তীয় বা উপ-ক্রান্তীয় জলবায়ু বিরাজ করছিল।
মেসোজোয়িক এরার শেষে পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দেখলে আমাদের মনে হবে কোন ভিনগ্রহে চলে এসেছি। কারণ তখনও আমাদের পরিচিত অধিকাংশ জীবের জন্ম হয়নি। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ছিল কিছু প্রাচীন ধরণের ডিম পাড়া প্রাণী যাদেরকে আধুনিক প্লাটিপাসদের পূর্বপুরুষ বলা যেতে পারে। ছিল অপোসামের মত কোমরে ঝুলিবিশিষ্ট কিছু প্রাণী যাদেরকে বর্তমানে মারসুপিয়াল অববর্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, ক্যাঙ্গারুও এমন একটি প্রাণী। মারসুপিয়ালদের থেকে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়ে আলাদা করা যেতো কিছু স্তন্যপায়ীকে। তা হল এপিপিউবিক (epipubic) অস্থি। শ্রোণীচক্রের হাড় থেকে বের হওয়া এই অস্থিটি বর্তমান ক্যাঙ্গারুদেরকে কোমড়ের ঝুলি ধরে রাখতে সাহায্য করে। মেসোজোয়িক এরার শেষ দিকে কিছু কীটভূক স্তন্যপায়ী এই হাড়টি হারিয়ে ফেলে, এরাই আমাদের পূর্বপুরুষ। এদর সাধারণ নাম প্ল্যাসেন্টাল (placental) স্তন্যপায়ী। বর্তমানের তৃণভোজী গবাদি পশুরাও প্ল্যাসেন্টাল স্তন্যপায়ী, তবে তখনও তৃণভূমির জন্ম হয়নি বিধায় এদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। কাঠবিড়ালি বা ছোট ছোট বীজভূক পাখিও আসেনি, কারণ ফুল উৎপাদনকারী উদ্ভিদেরও জন্ম হয়নি তখন। কিন্তু প্রশস্ত পাতাবিশিষ্ট গাছে বড় বড় বনভূমি গঠিত হচ্ছিল।
প্রাইমেটদের মত প্রথম প্রাণীগুলো দেখতে ছুঁচো ও কাঠবিড়ালির মতোই ছোট ছিল। উত্তর আফ্রিকায় পাওয়া সামান্য কিছু ফসিল থেকে জানা যায়, এরা উষ্ণ ও সিক্ত গেছো পরিবেশে চলাফেরা করতো। তাদের দৃষ্টিশক্তি সম্ভবত যথেষ্ট ভাল ছিল এবং গাছ বেয়ে ওঠার জন্য হাত-পায়ে নখরবিশিষ্ট প্যাড ছিল। তবে এতো কম ফসিল থেকে এর বেশি কিছু বলা সম্ভব না। এটুকু বলা যায় যে, এসব প্রাক-প্রাইমেটরা বাস্তুসংস্থানে বড় কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি যেটা পেরেছে প্রথম তৃণভোজী বৃহৎ স্তন্যপায়ীরা। কে/টি বিলুপ্তির পর সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তনই আসলে এই তৃণভোজীদের হাত ধরে এসেছিল। ঘাস-পাতা খেতে এদের জুড়ি ছিল না। তৃণভোজীদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করতে পেরে মাংসাশীরাও এবার ভাল রকমের সাফল্য লাভ করে। কুকুর, বিড়াল, ভালুক- এসব শিকারী প্রাণীদের উদ্ভব সে সময়টাতেই। নতুন পরিবেশ পেয়ে এ ধরণের অনেকগুলো প্ল্যাসেন্টাল প্রজাতির বিবর্তন ঘটে। এদের উদ্ভব যেহেতু উত্তর আমেরিকা ও ইউরেশিয়ার যুক্ত মহাদেশে ঘটেছিল সেহেতু অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনিতে এদের একেবারেই দেখা যায় না। দক্ষিণ আমেরিকা ২ কোটি বছর আগে উত্তর আমেরিকার সাথে মিলে যাওয়ার পর কুকুর-বিড়ালরা সেখানে যায় যে কারণে আবার সেখানকার অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
সাধারণ পূর্বপুরুষদের বয়ান
প্রাইমেট এবং সেই সাথে মানব বিবর্তনের ইতিহাসে আনুমানিক ৬.৩ কোটি বছর পূর্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। প্রাণবৃক্ষের প্রাইমেট শাখাটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। অবশ্যই এটি এমন তাৎক্ষণিক কোন ব্যাপার নয়, এবং বাস্তবিক অর্থে এমন কোন বিভাজন রেখা টানাটাও বৈজ্ঞানিক নয়। কিন্তু আমরা অন্তত এটুকু বলতে পারি যে, আগে সব প্রাইমেটই দেখতে মোটামোটি একরকম ছিল, ৬.৩ কোটি বছর পূর্বে ডাইনোসরবিহীন পৃথিবী পেয়ে তাদের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং আমরা দুই ধরণের প্রাইমেটের সাক্ষাৎ পাই: স্ট্রেপসিরাইন ও হ্যাপ্লোরাইন। স্ট্রেপসিরাইনদের নাক অনেকটা বর্তমান কুকুরের মতো, সকল লেমুর, লোরিস ও বুশবেবি এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। আর আমরা সহ বাকি সব প্রাইমেট হ্যাপ্লোরাইন। পূর্বের অধ্যায়ে প্রাইমেটদের শ্রেণীবিন্যাস পড়তে গিয়ে আমরা এদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। সেখানে আমরা কেবল শ্রেণীবিভাগ দেখেছিলাম। এবার দেখব ইতিহাসের ঠিক কোন যুগটাতে এই পরিবর্তনগুলো প্রকট হতে শুরু করেছিল। প্রাইমেটদের পুরো ইতিহাসই নিচের বংশবৃক্ষটির মাধ্যমে বোঝানো সম্ভব।

প্রাণবৃক্ষের কেবল প্রাইমেট শাখাটিকে সময়ের আবর্তে কিভাবে বিভাজিত হয়েছে তাই দেখা যাচ্ছে এখানে। ৬.৩ কোটি বছর আগে শুরু হয়ে এই বিভাজন শেষ হয়েছে প্রায় ৬০ লক্ষ বছর পূর্বে।
বংশবৃক্ষের কয়েকটি ছেদবিন্দুতে কালো ডট ও সাথে একটি সংখ্যা দেখা যাচ্ছে। এই সংখ্যাগুলো দিয়েই আমরা মানব বিবর্তনের ইতিহাস রচনা করব। ছেদবিন্দু থেকে যে দুটি শাখা বেরিয়া যাচ্ছে তারা দুটি প্রজাতির প্রতিনিধিত্ব করে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় গোঁড়ার বিন্দুতে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল যাদের থেকে এই দুটি প্রজাতির জন্ম হয়েছে। রিচার্ড ডকিন্স সাধারণ পূর্বপুরুষ শব্দটির একটি চতুর নাম দিয়েছেন- ইংরেজি common ও ancestor কে মিলিয়ে concestor. আমরাও এখন থেকে সেই সব সাধারণ পূর্বপুরুষদের কনসেস্টর ডাকবো। প্রাণবৃক্ষ বরাবর পেছাতে থাকলে আধুনিক মানুষের শাখাটি যখন অন্য কোন প্রাইমেট প্রজাতির শাখার সাথে মিলিত হয় তখনই একটি কনসেস্টর গণনা করা হবে। আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ হোমো ইরেক্টাস, কিন্তু তাদেরকে আমরা আপাতত গোণায় ধরব না, কারণ তারা বর্তমানে জীবিত অন্য কোন প্রাইমেট প্রজাতির পূর্বপুরুষ নয়, বরং কেবলই আমাদের শাখার সদস্য। এভাবে যেতে থাকলে সকল প্রাইমেটের সাধারণ পূর্বপুরুষ পর্যন্ত পৌঁছাতে আমরা দেখা পাব মোট আটটি কনসেস্টরের যাদেরকে বংশবৃক্ষে ১ থেকে ৮ পর্যন্ত সংখ্যা দিয়ে দেখানো হয়েছে। প্রথম কনসেস্টর ৬০ লক্ষ বছরেরও আগে পৃথিবীতে বাস করতো, আর ৬০ লক্ষ বছর আগে তাদের থেকে জন্ম নিতে শুরু করেছে দুটি প্রজাতি- মানুষ আর শিম্পাঞ্জি। দ্বিতীয় কনসেস্টর আবার একইসাথে কনসেস্টর ১ এবং গরিলার পূর্বপুরুষ। একইভাবে তৃতীয়টি ২য় কনসেস্টর এবং ওরাংওটাং এর পূর্বপুরুষ। নিচের টেবিলে সবগুলো কনসেস্টরের পরিচয় তুলে ধরা হল:

আমরা যাত্রা শুরু করব যথারীতি সকল প্রাইমেটের সাধারণ পূর্বপুরুষ তথা ৮ নম্বর কনসেস্টর দিয়ে যারা ৬ কোটি ৩০ লক্ষ বছর পূর্বে স্ট্রেপসিরাইন ও হ্যাপ্লোরাইন- এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এর আগে আফ্রিকা এবং সম্ভবত এশিয়ারও বিভিন্ন বনাঞ্চলে বাস করতো তারা। এরা দেখতে কেমন ছিল তার কিছুই আমরা জানতে পারতাম না যদি না উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্ট্রেপসিরাইন আজও জীবিত থাকতো। এদের বাঁচিয়ে রাখার পেছনে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে বিস্ময়কর একটি দ্বীপ- নাম তার মাদাগাস্কার। এ দ্বীপে মানুষ ছাড়া সকল প্রাইমেটই স্ট্রেপসিরাইন।
কনসেস্টর ৮: প্রোসিমিয়ান বিপ্লবের হোতা
মাদাগাস্কারের গল্পটা শুরু করতে হবে আরও আগে থেকে। আজ থেকে ১১০ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে একটিমাত্র মহাদেশ ছিল যার নাম রোডিনিয়া। ৭৫ কোটি বছর পূর্বে এটি ভেঙে যায় এবং কিছু অংশ দক্ষিণ গোলার্ধে চলে আসে। মহাদেশগুলো গতিশীল টেকটোনিক প্লেটের উপর অবস্থিত। এই গতিই রোডিনিয়ার ভগ্নাংশগুলোকে আবার একত্রিত করে প্রায় ৩০ কোটি বছর পূর্বে গঠন করেছিল প্যানজিয়া নামের বিখ্যাত মহাদেশটি। ২০ কোটি বছর আগে অবশ্য প্যানজিয়া ভেঙে উত্তরে লাউরেশিয়া ও দক্ষিণে গন্ডোয়ানা নামের দুটি মহাদেশ গঠিত হয়। মাদাগাস্কার তখনো গন্ডোয়ানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮ কোটি বছর পূর্বে জুরাসিক যুগের শুরুর দিকে গন্ডোয়ানার পূর্বাংশ আলাদা হয়ে যায়, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান মাদাগাস্কার, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা। ১৩ কোটি বছর আগে পশ্চিম গন্ডোয়ানাও আবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়- এবার পূর্বের অংশটি হয় আফ্রিকা আর পশ্চিমেরটি দক্ষিণ আমেরিকা। এরপর ৯ কোটি বছর পূর্বে মাদাগাস্কার পুরনো বন্ধু ভারতকেও ছেড়ে দেয়, হয়ে ওঠে একটি স্বাধীন দ্বীপ। মাদাগাস্কারের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে ভারত নির্বিঘ্নে এশিয়ার দিকে এগোতে শুরু করে যার পরিণতি আমরা একটু পরে জানব।

প্যানজিয়া সুপার-মহাদেশ যা দুই ভাগ হয়ে উত্তরে লাউরেশিয়া ও দক্ষিণে গন্ডোয়ানা গঠিত হয়েছিল
তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি কে/টি বিলুপ্তির ঠিক পরপর বা হয়তো তারও আগে আফ্রিকা এবং এশিয়ায় সকল প্রাইমেটের সাধারণ পূর্বপুরুষ বাস করতো। তাদের থেকে বিবর্তিত স্ট্রেপসিরাইনদের একটি গোষ্ঠী কোন না কোনভাবে মাদাগাস্কারে পাড়ি জমিয়ে প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় আজও টিকে আছে। মাদাগাস্কারের লেমুররা তাই ৮ম কনসেস্টর সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু জানাতে পারে। তবে একটি প্রাচীন ফসিলও পাওয়া গেছে যা ৮ম কনসেস্টর সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে পারে। ফসিলটিকে অবশ্য Plesiadapiformes নামক একটা আলাদা বর্গে স্থান দেয়া হয়েছে। কেউ বলে এরাই কনসেস্টর ৮, কেউ বলে এরা কনসেস্টর ৮ এর আপন ভাই। ফসিল থেকে দেখা গেছে এরাই প্রথম প্রাণী যাদের আঙুলে নখড়ের বদলে নখ ছিল।

কনসেস্টর ৭: ভূতের বাপ
গত অধ্যায়ে ভুতুড়ে টারশিয়ারদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম আমরা। প্রাচীন মানুষেরা টারশিয়ারদের মতো প্রাণী দেখেই ভূতের ধারণা পেয়েছিল কিনা কে বলতে পারে। এদের চোখটা বিশাল বড়, এজন্যই তারা চোখের পাতা ফেলতে পারে না। আর চোখের পাতা ফেলতে পারে না বলেই অন্যদিকে দেখতে হলে পুরো ঘাড় ঘুরাতে হয়। কোন কোন টারশিয়ার মাথা পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ফেলতে পারে, কি ভয়ংকর ব্যাপার! আমাদের সপ্তম কনসেস্টররা এই ভূতের বাপ এবং দেখতে তারা টারশিয়ারদের বেশ কাছাকাছি ছিল। বংশবৃক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে ৫ কোটি ৮০ লক্ষ বছর পূর্বে ভূতের বাপ দুটি নতুন প্রজাতির জন্ম দিতে শুরু করে, যার একটি প্রজাতি মুহুর্মুহু বিবর্তনের মাধ্যমে হয়েছে মানুষ, আরেকটি সেই ভূতই থেকে গেছে।
টারশিয়ারদের দেখে ৭ম কনসেস্টর সম্পর্কে অনেক কিছু জানা সম্ভব। প্রথম প্রশ্ন হতে পারে, টারশিয়ারদের মতো তারাও কি নিশাচর ছিল। উত্তরের জন্য চোখের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন যা প্রাইমেট ছাড়া সকল নিশাচর স্তন্যপায়ীরই আছে। এর নাম ট্যাপেটাম লুসিডাম। এটি আসলে চোখের রেটিনার পেছনে অবস্থিত একটি প্রতিফলক স্তর যা আপতিত আলোকে প্রতিফলিত করে আবার ফেরত পাঠায় যাতে রেটিনা দ্বিতীয়বারের মত তা গ্রহণ করতে পারে। এ কারণে রাতের স্বল্প আলোতেও নিশাচররা অনেক কিছু দেখতে পায়। কিন্তু কোন প্রাইমেট এমনকি টারশিয়ারেরও এটা নেই। তাই ধারণা করা হয়, ৭ম বা ৮ম কনসেস্টর কোন এক পর্যায়ে একই সাথে নিশাচর ও দিবাচর ছিল। দিনের বেলা চলতে পারে বলে তাদের ট্যাপেটাম লুসিডামের দরকার ছিল না। হয়তো ডাইনোসরদের যুগে সবাই নিশাচর ছিল এবং সব স্তন্যপায়ীরই ট্যাপেটাম লুসিডাম ছিল। কিন্তু কে/টি বিলুপ্তির পর প্রতিযোগিতা না থাকায় অনেকে দিনের বেলায়ও খাদ্যের সন্ধানে বের হতে পারে এবং ট্যাপেটাম লুসিডাম হারায়। কোন এক কারণে টারশিয়াররা আবার রাতের জীবনে ফিরে গেছে কিন্তু ট্যাপেটাম লুসিডাম পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। এর বদলে তাদের চোখের আকারটা অনেক বেড়ে গেছে যাতে যত বেশি সম্ভব ফোটন সংগ্রহ করা যায়।
তাই অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ৭ম কনসেস্টরও একইসাথে নিশাচর ও দিবাচর ছিল এবং তাদের ট্যাপেটাম লুসিডাম ছিল না। দিনরাত্রির জীবনে অভ্যস্ততা ছাড়া টারশিয়ারদের সাথে তাদের বোধহয় আর তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। তারা হয়তো অনেকটা Omomyidae ফসিল পরিবারের প্রাণীদের মত ছিল। ওমোমাইডরা ৫.৫ থেকে ৩.৪ কোটি বছর পূর্ব পর্যন্ত জীবিত ছিল, তাদের চোখ টারশিয়ারদের মতো বড় না হলেও নিশাচর হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। ৭ম কনসেস্টরদেরকে বলা যায় নিশাচর ওমোমাইডদের নিশাচর-দিবাচর সংস্করণ। এই পূর্বপুরুষদেরই একটি গোষ্ঠী সূর্যের আলোকে ভালবেসেছে, সূর্যও তাদের দুহাত ভরে দিয়েছে, ফলশ্রুতিতে তাদের থেকে জন্ম হয়েছে মানুষসহ সকল অ্যানথ্রোপয়েড প্রজাতির; আর একটি গোষ্ঠী ফিরে গেছে রাতের অন্ধকারে আর পরিণত হয়েছে বর্তমান টারশিয়ারে।
কনসেস্টর ৬: বাঁদরামোর জনক
ইয়োসিন ইপকের প্রোসিমিয়ানদের মধ্যেই এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আসতে শুরু করেছিল যা পরবর্তী সিমিয়ান তথা বানরদের কাছাকাছি। তাদের মস্তিষ্ক ও চোখ বড় হচ্ছিল আর নাক দিনদিন ছোট হচ্ছিল। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি এসেছিল ফোরামেন ম্যাগনামে। প্রাইমেটদের মস্তিষ্কের পেছনের অংশে তথা ভিত্তিভূমিতে একটি ছিদ্র থাকে যেখান দিয়ে সুষুম্না কাণ্ড (spinal cord) প্রবেশ করে। এরই নাম ফোরামেন ম্যাগনাম, লাতিন ভাষায় যার অর্থ বড় ছিদ্র। এই ছিদ্রের অবস্থান দেখে বলে দেয়া যায় প্রাণীটির দেহ অনুভূমিক (ঘোড়ার মত) বা উল্লম্ব (বানরের মত) কোন অবস্থানে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ইয়োসিন যুগের কিছু প্রোসিমিয়ানদের ফোরামেন ম্যাগনাম করোটিকার পেছন থেকে সরে কেন্দ্রের দিকে চলে আসছিল। এ থেকেই বোঝা যায় তখন তারা দুই পায়ের উপর ভর করে বসতে শুরু করেছিল। তবে ইয়োসিন ইপকের শেষদিকে অনেকগুলো প্রোসিমিয়ান প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, সম্ভবত তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে।
অবশ্য বিলুপ্ত হওয়ার আগেই সিমিয়ানদের উদ্ভব ঘটে যায়। ইয়োসিন কেবল প্রোসিমিয়ান নয় সিমিয়ানদের জন্যও আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল। এর একটি বড় কারণ পরিবেশ। তখন পৃথিবীর যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছিল অসংখ্য ক্রান্তীয় বনভূমি। আজকের বিরান অ্যান্টার্কটিকার কিছু অংশও তখন সবুজ ছিল। স্বর্গ বলে এখন কিছু না থাকলেও সে সময় গোটা পৃথিবীটাই ছিল স্বর্গ। সেই স্বর্গোদ্যানেই আনুমানিক ৪ কোটি বছর পূর্বে ৬ষ্ঠ কনসেস্টর প্রথম বানরদের জন্ম দেয়। কিন্তু সে সময় দুই ধরণের বানরের দেখা মেলে: নতুন দুনিয়ার প্ল্যাটিরাইন বানর ও পুরনো দুনিয়ার ক্যাটিরাইন বানর। নতুন দুনিয়া বলতে আমেরিকা ও পুরনো দুনিয়া বলতে যে আফ্রিকা ও ইউরেশিয়া বোঝানো হয় সেটা আমরা শ্রেণীবিন্যাস পর্বেই জেনেছি। পুরনো দুনিয়ায় বানরদের জন্ম আমরা পরের কনসেস্টরের কাছে শুনবো। এখানে নতুন দুনিয়ার বানরদের কথা বলা যাক। কারণ ৬ষ্ঠ কনসেস্টরদের উত্তরসূরীদের মধ্যে এরাই প্রথম আমাদের সাথে গভীর আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে নতুন দুনিয়ার বানররা কি দক্ষিণ আমেরিকাতে আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়েছিল নাকি আফ্রিকায় জন্ম নিয়ে পরবর্তীতে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। আজকের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নটিকেই উদ্ভট মনে হবে। কারণ আফ্রিকা থেকে আমেরিকা যাওয়া আর যাই হোক কোন বানরে পক্ষে যে সম্ভব না সেটা সবাই বোঝেন। কিন্তু ৪ কোটি বছর পূর্বে দক্ষিণ আমেরিকা আফ্রিকার বেশ কাছে ছিল এবং সমুদ্রে পানির উচ্চতাও ছিল কম। এর ফলে হয়ত আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ জেগে উঠেছিল। এই পরিবেশে আফ্রিকা থেকে কিছু বানর ম্যানগ্রোভ জলাভূমিকে ভেলা হিসেবে ব্যবহার করে নিজের অজান্তেই এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ হয়ে এক সময় দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছিল। ম্যানগ্রোভ জলাভূমিগুলো হয়ত জীবন-বান্ধব ছিল এবং পানির স্রোতও হয়ত তাদের অনুকূলে ছিল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একই সময় রোডেন্টদের (কাঠবিড়ালির মত প্রাণী) একটি প্রজাতিও দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছেছিল যাদের নাম হিস্ট্রিকগন্যাথ রোডেন্ট। আগে জেনেছি স্ট্রেপসিরাইনরাও অনেকটা এভাবে আফ্রিকা থেকে মাদাগাস্কার পৌঁছেছে।
এই অভিপ্রয়াণের ব্যাপারে অনেকে একমত হলেও প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি কেবল একবারই ঘটেছিল নাকি বানরদের অনেকগুলো গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে আফ্রিকা ত্যাগ করে নতুন দুনিয়ায় গেছে? সমাধানের উপায়ও আছে। নতুন দুনিয়ার প্রজাতিগুলো যদি আফ্রিকার কেবল একটি প্রজাতির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত হয় তাহলে বলতে হবে অভিপ্রয়াণ একবার ঘটেছিল। আর যদি দেখা যায় নতুন দুনিয়ার কিছু প্রজাতি আফ্রিকার এক প্রজাতির সাথে সম্পর্কিত আবার অন্য কিছু প্রজাতি আফ্রিকার অন্য এক প্রজাতির সাথে সম্পর্কিত তাহলে বলতে হবে, অভিপ্রয়াণ বারবার ঘটেছে। ডিএনএ বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত দেখা গেছে প্রথমটিই সত্যি, একবারের বেশি হয়ত ব্যাপারটা ঘটেনি।
আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটাকে খুবই অস্বাভাবিক মনে হয়। আফ্রিকা থেকে আমেরিকা যতোই কাছে হোক আর মাঝখানে যতগুলো দ্বীপই থাকুক, সন্দেহ কাটে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, অভিপ্রয়াণ যদি কেবল একবার ঘটে তাহলেই যথেষ্ট। হয়তো কেবল একটি গর্ভবতী পুরনো দুনিয়ার বানর ভাসমান ম্যানগ্রোভ জলাভূমিতে চেপে বসেছিল আর জীবন ধারণে সক্ষম ভেলাটি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নতুন দুনিয়ায়। এভাবে কোন পাসপোর্ট ছাড়াই সে হয়ে গিয়েছিল নতুন দুনিয়ার বাসিন্দা। একজন মানুষের জীবদ্দশায় এমনটি দেখার সম্ভাবনা খুব কম মনে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে আফ্রিকাতে পুরনো দুনিয়ার বানর কয়েক কোটি বছর ধরে রাজত্ব করছিল। এক কোটি বছরে অন্তত একবার কি এমন কিছু ঘটতে পারে না?
আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে, এযুগের কিছু অসচেতন অভিপ্রয়াণের উদাহরণ দেয়া যাক। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ানের সবুজ ইগুয়ানা এক বিশালাকৃতির টিকটিকি প্রজাতি। এদের দৈর্ঘ্য সাধারণত এক মিটার তবে সর্বোচ্চ দুই মিটার পর্যন্ত হতে পারে। ১৯৯৫ সালের ৪ঠা অক্টোবর ১৫টি এমন ইগুয়ানা ক্যারিবিয়ানের আংগুইলা দ্বীপের পূর্ব উপকূলে হাজির হয়েছিল একেবারে ভেলায় ভেসে। ভেলাটি ছিল আসলে উপড়ে পড়া বেশ কিছু গাছের গুড়ি, যার কোন কোনটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ ফুট। হয়তো অন্য কোন দ্বীপে গাছের গুড়িতে তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল, এমন সময় হারিকেনের কারণে গাছগুলি উপড়ে পড়ে সমুদ্রে ভেসে যায়। উল্লেখ্য ক্যারিবিয়ানের পূর্ব উপকূলে এর মাত্র ১ মাস এবং ১৫ দিন আগে দুটি ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। ১৯৯৮ সালেও আংগুইলাতে অন্তত একটি প্রজননে সক্ষম স্ত্রী ইগুয়ানা দেখা গেছে।
ব্যাপারটা আসলেই শ্বাসরুদ্ধকর, কোনভাবে কেবল একবার ভূমিতে পৌঁছুতে পারলেই জীবন তার নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। বাকিটা শুধুই ইতিহাস। বাণের জলে ভেসে আসা কেবল একটি প্রাণীই পারে তার পুরো প্রজাতির ভাগ্য এবং কালের প্রবাহে পৃথিবীর একটি বিশাল অংশের চেহারা পাল্টে দিতে। ৪ কোটি থেকে আড়াই কোটি বছর পূর্বের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে পুরনো দুনিয়ার বানররা এই বৈপ্লবিক কাজটিই করেছিল। তবে তারা আফ্রিকা ছেড়ে গেছে বলেই যথারীতি আমাদের সাথে তাদের সম্পর্ক খুব কম। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন- আমি যে নতুন ও পুরনো দুনিয়ার বানরদের কথা এখানে বললাম তারা কিন্তু বর্তমান বানরদের মতো নয়, বরং বর্তমান বানরদের পূর্বপুরুষ। এই প্রাচীন সিমিয়ানদের বিবর্তনের ইতিহাসটি বেশ করুণ, কারণ যে প্রোসিমিয়ানদের থেকে তারা বিবর্তিত হয়েছে, তাদের কারণে সেই প্রোসিমিয়ানরাই বিলুপ্ত হতে বসেছিল। বিস্তারিত জানতে আমাদের প্রবেশ করতে অলিগোসিন যুগে।
কনসেস্টর ৫: অলিগোসিন যুগের প্রতাপশালী বানর

প্রোসিমিয়ানদের থেকে ইয়োসিন যুগের শেষ ও অলিগোসিন যুগের শুরুতে বানর তথা সিমিয়ানদের উদ্ভব ঘটেছিল, যে বানরদের কেউ কেউ আফ্রিকা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকায়। বানররা অ্যানথ্রোপয়ডিয়া উপবর্গের প্রথম সদস্য, অর্থাৎ আমাদের বেশ নিকট আত্মীয়। এই উপবর্গের সব প্রাণীকে অ্যানথ্রোপয়েড নামেও ডাকা হয়। মানুষের কাছাকাছি বলেই নামের আগে anthro-শব্দটি রয়েছে। এসব আদিম বানরের বেশ কয়েকটি গণ সনাক্ত করা হয়েছে, Apidium ও Aegyptopithecus সর্বাধিক পরিচিত। অ্যাপিডিয়ামের আকার মোটা কাঠবিড়ালির সমান আর ইজিপ্টোপিথেকাসের আকার গৃহপালিত বিড়ালের সমান। দুই গণের সদস্যরাই সম্ভবত গাছে গাছে চড়ে বেড়াতো আর ফল ও বীজ খেয়ে বেঁচে থাকতো। আদিম প্রোসিমিয়ানদের থেকে যে বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের আলাদা করেছে তা হল: অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক দাঁত, বড় মস্তিষ্ক, আরও সামনের দিকে তাক করা চোখ এবং শিয়ালের মত চোখা ও বড় নয় বরং সরল নাক।
ইয়োসিন ইপককে প্রোসিমিয়ান বিপ্লবের যুগ বললে অলিগোসিন ইপককে অবশ্যই সংজ্ঞায়িত করতে হবে বানর বিপ্লবের মাধ্যমে। খাদ্য সংগ্রহের দক্ষতায় সিমিয়ানরা প্রোসিমিয়ানদের হারিয়ে দিয়েছিল। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, নতুন নির্বাচনী চাপের সাথে অভিযোজন করতে গিয়ে অনেক প্রজাতিই তার পূর্বসূরীর তুলনায় আরও কার্যকরী বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। অলিগোসিন যুগে প্রোসিমিয়ানদের সংখ্যা হ্রাসের কারণ যে সিমিয়ানদের আধিপত্য এতে সন্দেহের অবকাশ খুব কম। কারণ, কেবল সে অঞ্চলগুলোতেই অনেক প্রোসিমিয়ান দেখা যায় যেখানে বানর নেই। আর বানর ও প্রোসিমিয়ান উভয়েই যেখানে আছে সেখানকার প্রোসিমিয়ানরা সাধারণত নিশাচর হয়, যাতে রাতের বেলা যখন অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান বানররা ঘুমিয়ে থাকে তখন তারা খাদ্য সংগ্রহের কাজটা সেরে নিতে পারে।
অলিগোসিন যুগে বিবর্তনের গতিপথ পরিবর্তিত হওয়া ও কম ফসিল পাওয়া দুটোর কারণই ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। এই যুগের শুরুতে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ আলাদা হয়ে দুটো পৃথক মহাদেশের জন্ম দেয়। গঠিত হয় পূর্ব আফ্রিকার গ্রেট রিফ্ট ভ্যালি বা বৃহৎ ফাটল উপত্যকা। বিশাল কয়েকটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝখানে অবস্থিত আগ্নেয়ভাবে সক্রিয়া ফল্ট জোন বরাবর প্রায় ১২০০ মাইল দীর্ঘ এই উপত্যকা গড়ে উঠেছিল। এর আগে ইয়োসিন যুগের শুরুর দিকে অর্থাৎ ৫.৫ কোটি বছর পূর্বে ভারত এশিয়ার সাথে ধাক্কা খায়, যার ফলে জন্ম হয় পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতমালা হিমালয় এবং এর অপর পার্শ্বে তিব্বতীয় সমভূমির। অলিগোসিন যুগে হিমালয় বায়ুপ্রবাহের জন্য একটি বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় যার ফলে পাল্টে যায় পুরো মহাদেশের জলবায়ু। এমন আরও কিছু কারণে পুরো পৃথিবীর জলবায়ুই অনেকটা বদলে গিয়েছিল সে যুগে। ইয়োসিন যুগের শেষে পৃথিবী শীতল ও শুষ্ক হতে শুরু করেছিল যা এ যুগে আরও প্রকট রূপ ধারণ করে, বিশেষ করে উত্তর গোলার্ধে। তারপরও অবশ্য ভৌগলিক তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে বেশি ছিল।
এ যুগের শেষ দিকে আফ্রিকা বাকি পুরো বিশ্ব থেকে একেবারে আলাদা ছিল। সবচেয়ে নিকটবর্তী স্থলভূমি স্পেনও ছিল বিশাল সাগর দিয়ে পৃথক করা। এখানেই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে গিয়ে পুরনো দুনিয়ার বানরদের অনেকগুলো প্রজাতির জন্ম হয়। বর্তমানের সকল পুরনো দুনিয়ার বানরদের কনসেস্টর সম্ভবত আজ থেকে ১.৪ কোটি বছর পূর্বে বাস করতো। এই কনসেস্টর সম্পর্কে জানার সবচেয়ে ভাল উপায় ভিক্টোরিয়াপিথেকাস নামক একটি ফসিল। ভিক্টোরিয়া হ্রদের মাকাবো দ্বীপ থেকে এই প্রজাতির একটি সম্পূর্ণ খুলি পাওয়া গেছে, এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে মিলেছে কয়েক হাজার ফসিলের টুকরো। প্রায় ৩ কোটি বছর পূর্বে যদি পুরনো দুনিয়ার বানরদের জন্ম হয়েছে ধরে নেয়া হয় তাহলে বলতে হবে, অর্ধ কোটি বছরে খুব বেশি পরিবর্তিত হয়নি তারা। তারপর ২.৫ কোটি বছর পূর্বে আদিম পুরনো দুনিয়ার বানরদের কোন প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়েছে প্রথম নরবানর, অর্থাৎ লেজবিহীন বানর। আমরা নিজেরাও নরবানর। ৫ম কনসেস্টর সম্ভবত পূর্বে উল্লেখিত ইজিপ্টোপিথেকাস নামক ফসিল প্রজাতিটির মতো ছিল, কিংবা হয়তোবা সে নিজেই আমাদের ৫ম কনসেস্টর।
ক্যাটিরাইনি অণুবর্গের দুটি অধিপরিবারের কথা জেনেছি আমরা- হোমিনয়ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত সকল নরবানর আর সার্কোপিথেকয়ডিয়া সকল পুরনো দুনিয়ার বানরদের জন্য বরাদ্দ। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরু ও নিম্নমুখী নাক। এর বিপরীতে প্ল্যাটিরাইনদের নাক ছিল প্রশস্ত ও বোঁচা। কে জানে হয়তো নিম্নমুখী হওয়ার কারণে আমাদের পূর্বপুরুষদের নাকে বৃষ্টির পানি ঢুকতে পারতো না। তারা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিল মায়োসিন যুগে।
৪র্থ কনসেস্টর: মায়োসিন যুগের নরবানর

অলিগোসিন ইপক শেষ ও মায়োসিন ইপক শুরুর এমন একটি সময়েই নরবানরদের উৎপত্তি ঘটে। বংশবৃক্ষে আমরা দেখেছি পুরনো দুনিয়ার বানরদের শাখাটি দুই ভাগ হয়ে গেছে আড়াই কোটি বছর আগে, একটির সদস্য আধুনিক পুরনো দুনিয়ার বানররা, আরেকটির সদস্য সকল নরবানর। তারপর ১.৪ কোটি বছর আগে পুরনো দুনিয়ার বানরদের শাখাটির আরও বিভাজন ছবিতে দেখানো হয়নি কারণ মানব বিবর্তনের জন্য সেটা খুব দরকারি নয়। আমাদের চোখ রাখতে হবে নরবানর শাখাটির দিকে যা ইনসেটে আরও বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ বছর পূর্বে নরবানর শাখা প্রথমবারের মত ভাগ হয়। একটি চলে যায় গিবনদের দিকে আরেকটি হোমিনিডাই পরিবারের দিকে যার সদস্য আমরা। এ সময় আফ্রিকা এবং এশিয়ার মধ্যে কোন বাঁধা ছিল না। তাই গিবন পাওয়া যায় কেবল পূর্ব এশিয়ায়। গিবনদের পূর্বপুরুষরা কিভাবে এশিয়ায় এসেছেন সেটা একটু পরেই বলছি। আপাতত গিবন ও আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ অর্থাৎ ৪র্থ কনসেস্টর কেমন ছিল তা বোঝার জন্য আধুনিক গিবনদের একটু ভালভাবে লক্ষ্য করা যাক।
প্রথমত, গিবনরা ব্র্যাকিয়েশনে কতোটা দক্ষ তা আমাদের যৌথ পরিবার পর্বেই জেনেছি। কিন্তু এটা বলা হয়নি যে তারা দুই পায়েও হাঁটতে পারে। সত্যি বলতে মানুষের পরই দুই পায়ে হাঁটতে সবচেয়ে দক্ষ প্রাইমেট হচ্ছে গিবন। তারা গাছের ডালে দুই পায়ে হেঁটে বেড়ায় আর এক ডাল থেকে আরেক ডালে যেতে ব্যবহার করে ব্র্যাকিয়েশন- দুই হাত দিয়ে পেন্ডুলামের মতো ঝুলে ঝুলে মহা আনন্দে এক ডাল থেকে আরেক ডালে ঘুরে বেড়ায় তারা। ৪র্থ কনসেস্টরদেরও কি দুই পায়ে সামান্য দূর পর্যন্ত হাঁটা ও ব্র্যাকিয়েশনের ক্ষমতা ছিল? থাকার সম্ভাবনাই বেশি। হয়তো সেই আদিম দ্বিপদিতাই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ৭০ লক্ষ বছর আগের আফ্রিকান সাভানাতে যখন সত্যিকারের দ্বিপদিতার চর্চা শুরু করে আমাদের পূর্বপুরুষরা। আর আমাদের পূর্বপুরুষরা কখনো ব্র্যাকিয়েশনের মতো মজার একটা কাজ করতে পারেনি তা ভাবতেই খারাপ লাগে। আসুন ধরে নেই, আমরা এক সময় লম্বা হাত দিয়ে এক গাছ থেকে লাফ দিয়ে চলে যেতাম আরেক গাছে, আমাদের জীবন চলতো গাছের ডগায় ডগায়, আমাদের চোখ কখনো মাটির দিকে নামতো না।
গিবনদের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা জেনেছি আমরা: সুরে সুরে যোগাযোগ করা। গিবনদের বাকযন্ত্র অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনায় বেশ উন্নত। হয়তোবা ৪র্থ কনসেস্টরেরও এটা ছিল, এ কারণেই কি আমরা কথা বলতে এতো ওস্তাদ? একটা বিষয়ে পৃথিবীর সকল জাতির মানুষ সমান পারদর্শী, তা হল সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতের উত্তরাধিকার কি আমরা দুই কোটি বছর আগের গিবনরূপী পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম? হয়তো তাই! তবে একটা বিষয়ে আবার গিবনরা বেশ আলাদা। ওরা একেবারে বিশ্বস্ত একগামী, অন্যদিকে মানুষ এবং অন্যান্য সকল বৃহৎ নরবানর বহুগামী, এক সঙ্গী-তে আমাদের মন ভরে না। আমরা তো আবার বহুগামিতাকে আস্কারা দেয়ার জন্য কিছু ধর্মই তৈরি করেছি।
৪র্থ কনসেস্টরদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা আকারে বেশ ছোট ছিল, বর্তমান গিবনদের মতোই। আকারে বাড়া বা কমা বিভিন্ন নির্বাচনী চাপের সাথে খাপ খাওয়ানোর খুব কার্যকরী উপায়। নরবানরদের এই স্বর্ণযুগে অনেকেই আকারে ছোট হয়ে গিয়েছিল। যেমন, প্লায়োপিথেকাস নামের একটি ছোট নরবানর মায়োসিন যুগেই ইউরোপে বাস করতো, গিবনদের মত ব্র্যাকিয়েট করতে পারলেও তারা গিবনদের পূর্বপুরুষ নয়। মনে রাখতে হবে গিবন ও আমাদের কনসেস্টরই কিন্তু সকল নরবানরের কনসেস্টর। মোটামোটি নিশ্চিত যে এদের লেজ ছিল না। আরও সঠিক করে বললে, তাদের লেজের হাড় দেহের ভেতর একটি খুবই ছোট অভ্যন্তরীন লেজ গঠন করেছিল যার নাম কক্সিক্স, আমাদের দেহেও এটি আছে। একে অনেক সময় টেইলবোন বা লেজুরাস্থিও বলা হয়। লেজ হারানো নিয়ে একটু কথা বলার সবচেয়ে ভাল সময় এটাই।
আসলে স্পষ্ট ভাষায় এর উত্তর দেয়া সম্ভব না। তবে একটা সুবিধা হচ্ছে শুধু নরবানর নয় আরও অনেক প্রাণীই লেজ হারিয়েছে। যদিও লেজবিহীন প্রাইমেটদের নরবানর বলার চল আছে, তথাপি কিছু বানর এবং মাদাগাস্কারের কিছু লেমুরেরও কিন্তু লেজ নেই। লেজ হারানোর সবচেয়ে সাধারণ ব্যাখ্যা হতে পারে অপ্রয়োজনীয়তা। কোন অঙ্গের প্রয়োজনীয়তা ফুরালে সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতার খাতিরেই তার আকার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছোট হতে থাকার কথা। স্তন্যপায়ীদের লেজের বহুবিধ ব্যবহার আছে। যেমন, কাঠবিড়ালির লেজ বাতাসে ভর করে অনেক দূর পর্যন্ত লাফ দিতে সাহায্য করে। গেছো প্রাণীদের লেজ সাহায্য করে ভারসাম্য রক্ষায়। যারা গাছে খুব বেশি লাফালাফি করে না তাদের লেজ ছোট, যেমন লোরিস। আবার বুশবেবি লোরিসের নিকটাত্মীয় হলেও আদর্শ গেছো জীবনের জন্য তার দীর্ঘ্য লেজ আছে। বোর্নিও ও সুমাত্রায় স্থলচর মাকাকদের লেজ ছোট কিন্তু গেছো মাকাকদের লেজ দীর্ঘ্য। বানরদের মধ্যে যারা গাছে খুব সক্রিয় তাদের লেজ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ্য। তারা ডালের উপর দিয়ে অনুভূমিকভাবে হেঁটে যায়, আর পেছনের লেজটা ভারসাম্য রক্ষার লাঠি হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু গেছো জীবনে লেজের এতো দরকার থাকলে সারাজীবন গাছে চরে বেড়ানো গিবনদের লেজ নেই কেন? উত্তর সম্ভবত নিহিত আছে গাছে চলাফেরার ভঙ্গিতে। অধিকাংশ নরবানরই একটু হলেও দুই পায়ে হাঁটতে পারে। গিবনরা ডালের উপর হাঁটাচলা করে দুই পায় এবং তখন দুই হাতকে ভারসাম্য রক্ষার কাজে ব্যবহার করতে পারে। আসলে যেকোন দ্বিপদীর জন্যই লেজ একটা অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ এবং হয়তো বিরক্তিকরও। তাছাড়া গিবনরা এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফ দেয়ার সময় দেহটি উল্লম্ব অবস্থানে রাখে, অন্যদিকে বানররা রাখে অনুভূমিক অবস্থানে। তাই গিবনদের ক্ষেত্রে লেজ ভারসাম্য রক্ষার পরিবর্তে উল্টো তাকে নিচের দিকে নামিয়ে ফেলতে চাইবে। কারণ উল্লম্বভাবে লাফ দিলে লেজটা থাকবে নিচের দিকে। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় লেজের ভাগ্যে তাই হয়তো বিলুপ্তি ভিন্ন অন্য কোন পথ খোলা ছিল না।
৩য় কনসেস্টর: এশিয়া জয়ের নায়ক
১ কোটি ৪০ লক্ষ বছর পূর্বে মায়োসিন যুগের একেবারে মাঝামাঝি সময়ে মানুষ, শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং ওরাংওটাং এর সাধারণ পূর্বপুরুষ তথা ৩য় কনসেস্টর পৃথিবীতে বিচরণ করছিল। আণবিক জীববিদ্যা থেকে এর বেশ শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু এই পূর্বপুরুষ ঠিক কোথায় বাস করতো তা এক কথায় বলে দেয়া সম্ভব না।
তখন বর্তমান তুষার যুগ কেবল শুরু হচ্ছিল, তারপরও জলবায়ু বেশ উষ্ণ ছিল এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের চেয়ে একটু বেশিই ছিল। এ কারণে আফ্রিকা ও এশিয়া সংযোগভূমি এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের কিছু অংশ মাঝেমাঝে পানিতে ডুবে যাচ্ছিল আবার ভেসে উঠছিল। গিবন ও আমাদের কনসেস্টরের জন্য যেমন আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না এবার আর নিরবচ্ছিন্নভাবে তেমনটি সম্ভব না। শিম্পাঞ্জি ও গরিলাদের সাথে আমাদের গভীর সম্পর্ক মাত্র কয়েক দশক আগে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর আগে বিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা এশীয় ও আফ্রিকান নরবানরদের সাথে একই পরিমাণ সম্পর্কিত। এশিয়ার পক্ষে যুক্তি ছিল, মায়োসিন যুগের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত সেখানে প্রচুর নরবানরের ফসিল পাওয়া গেছে। তাই মায়োসিনের শেষ দিকে আমাদের পূর্বপুরুষরা এশিয়াতেই বাস করতো বলে মনে করতেন অধিকাংশ বিজ্ঞানী। কেউ কেউ আবার রামাপিথেকাস নামক একটি এশীয় ফসিল গণকে আমাদের পূর্বপুরুষ হিসেবে আখ্যাই দিয়ে দিয়েছিলেন। পরে জানা গেছে আরও আগে সিভাপিথেকাস নামের যে ফসিল পাওয়া গিয়েছিল তার সাথে রামাপিথেকাসের কোন পার্থক্য নেই। বর্তমানে দুটিকে বোঝাতে কেবল সিভাপিথেকাস নামটিই ব্যবহৃত হয়। যে নামেই ডাকা হোক না কেন পরে বোঝা গেছে সিভাপিথেকাস আমাদের তুলনায় ওরাংওটাংদের পূর্বপুরুষের সাথে বেশি সম্পর্কিত, এমনকি সে তাদের সরাসরি পূর্বপুরুষও হতে পারে।
এছাড়া আরও কিছু এশীয় ফসিল ছিল। যেমন, জাইগান্টোপিথেকাস ছিল সিভাপিথেকাসের একটি স্থলচর ও বড় সংস্করণ। এক সময় Ouranopithecus এবং Dryopithecus মানুষের পূর্বপুরুষ হতে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। কিন্তু জিনতত্ত্ব এসে তাদেরকে হারিয়ে দিল। আণবিক পরীক্ষা নীরিক্ষা শেষে বিজ্ঞানীরা বললেন গরিলা ও শিম্পাঞ্জিরাই আমাদের সবচেয়ে নিকটাত্মীয়। আফ্রিকা ছাড়া আর কোথাও এদের দেখা যায় না। তাই আফ্রিকার পক্ষেই রায় দিলেন বিজ্ঞানী সমাজ। এশিয়াকে সবাই ভুলেই গেলেন বলা যায়। কিন্তু সমস্যা হল মায়োসিন যুগের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত আফ্রিকায় প্রাইমেট ফসিলের অভাব। সেখানে মায়োসিন যুগের শুরুতে নরবানরের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। আফ্রিকায় সে সময়কার প্রোকনসাল গণের অনেকগুলো প্রজাতির ফসিল পাওয়া গেছে। এছাড়া আছে আফ্রোপিথেকাস ও কেনিয়াপিথেকাসের ফসিল। কিন্তু তার পর গঠাৎ কেন হারিয়ে গেল সব ফসিল? তাও বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়লেন না; বললেন, আমাদের বিবর্তনের পুরো ইতিহাসটাই আফ্রিকাতে, মাঝখানের এই সময়টার ফসিল কোন কারণে সংরক্ষিত হয়নি।
১৯৯৮ সাল পর্যন্ত অবস্থা এমনই ছিল। কিন্তু সে বছর মার্কিন জীববিজ্ঞানী সি বি স্টুয়ার্ট ও টড ডিসোটেল “Primate evolution- in and out of Africa” নামে একটি সাড়া জাগানিয়া গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এতে দাবী করা হয় চিরকাল আফ্রিকাই আমাদের সূতিকাগার ছিল এটা ঠিক নয়। এর বদলে ২ কোটি বছর আগে নরবানরদের একটি দল আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল যারা বর্তমানে জীবিত ওরাংওটাং ও গিবন সহ সকল এশীয় নরবানরের জন্ম দিয়েছে। ওরাংওটাং ও গিবনরা এশিয়ায় থেকে গেলেও ১ কোটি বছর পূর্বে সেখান থেকে নরবানরদের আরেকটি দল পুনরায় আফ্রিকাতে ফিরে এসেছে। সেই অনুকল্পই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য যেটি সবচেয়ে কম স্বতঃসিদ্ধের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ব্যাখ্যা দিতে পারে। (ডকিন্সের মতে এই বিচারে চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব পৃথিবীর সেরা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।)
আপাতদৃষ্টিতে ‘চিরকাল আফ্রিকায় ছিল’ অনুকল্পটি কম স্বতঃসিদ্ধ গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়। কিন্তু এমন মনে হওয়ার কারণ শুধু আমাদের পূর্বপুরুষদের কথা বিবেচনা করা। এর বদলে ফসিল প্রজাতিসহ সকল নরবানরের পূর্বপুরুষ বিবেচনায় নিলে দেখা যায় পরিস্থিতি ভিন্ন। এই উদ্দেশ্যে স্টুয়ার্ট ও ডিসোটেল প্রথমেই ফসিল প্রজাতিসহ এখন পর্যন্ত জানা সকল নরবানরের একটি বংশবৃক্ষ তৈরি করেন। তারপর কোন নরবানরটি কোন মহাদেশের বাসিন্দা তা সনাক্ত করেন। নিচে তাদের ছবিটি দেখানো হয়েছে: লাল দ্বারা আফ্রিকান প্রজাতি ও কালো দ্বারা এশীয় প্রজাতি বোঝানো হয়েছে। পাশাপাশি তারা পুরনো দুনিয়ার বানরদেরও এই ছবিতে যোগ করেন যারা আড়াই কোটি বছর আগেই নরবানরদের থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। অভিপ্রয়াণের ঘটনাগুলো তীর চিহ্ন দ্বারা দেখানো হয়েছে। বৃত্তের ভেতরও আলাদাভাবে সময়সীমা উল্লেখ করা হয়েছে।

ছবি থেকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে এই অনুকল্প সত্য হতে হলে মাত্র দুটি স্বতঃসিদ্ধ অর্থাৎ দুটি অভিপ্রয়াণ ধরে নিতে হয়:
১। ২ কোটি বছর আগে আফ্রিকান নরবানরদের একটি গোষ্ঠী এশিয়া গিয়ে বর্তমানের সকল এশীয় নরবানরের জন্ম দিয়েছে।
২। ১ কোটি বছর পূর্বে আবার এশিয়া থেকে কিছু নরবানর আফ্রিকায় ফিরে এসে বর্তমান আফ্রিকান নরবানরদের জন্ম দিয়েছে। ২ কোটি বছর আগে যেসব নরবানর আফ্রিকায় থেকে গিয়েছিল তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
অন্যদিকে ‘চিরকাল আফ্রিকায় ছিল’ অনুকল্প সত্য হতে হল ছয়টি অভিপ্রয়াণ ঘটনা ধরে নিতে হয় যার সবগুলোই আফ্রিকা থেকে এশিয়ার দিকে, ছবি থেকেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। যেকোন দিকে যদি যাওয়া যায় তাহলে নরবানররা কেন শুধু একদিকে যাবে সেটাও এক প্রশ্ন। যাহোক অভিপ্রয়াণগুলো হচ্ছে:
১। ১ কোটি ৮০ লক্ষ বছর আগে গিবন
২। ১ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে অরিওপিথেকাস
৩। দেড় কোটি বছর আগে লুফেংপিথেকাস
৪। ১ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে সিভাপিথেকাস এবং ওরাংওটাং
৫। ১ কোটি ৩০ লক্ষ বছর আগে ড্রায়োপিথেকাস
৬। ১ কোটি ২০ লক্ষ বছর আগে আউরানোপিথেকাস
ছয়টি একমুখী অভিপ্রয়াণের তুলনায় দুইটি দ্বিমুখী অভিপ্রয়াণ ডকিন্সের মত আমাদের কাছেও বেশি গ্রহণযোগ্য ঠেকছে। তবে এই অনুকল্প সত্যি হতে হলে প্রথমে বংশবৃক্ষটিকে পুরোপুরি ঠিক হতে হবে এবং সেটা আসলেই করা সম্ভব কিনা তা প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির রিচার্ড ক্লাইন তো একটি পাঠ্যবইয়ে দাবী করে বসেছেন যে, আমাদের পূর্বপুরুষ অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতিটি আফ্রিকান কেনিয়াপিকাসের তুলনায় এশীয় আউরানোপিথেকাসের বেশি কাছাকাছি। এটা সত্যি হলে বংশবৃক্ষ গোলমেলে হয়ে যাবে। অ্যানাটমি অনুসারে ক্লাইনের কথায় কিছুটা সত্যতা থাকলেও ভাগ্য ভাল যে অন্তত ভূগোল ও মরফোলজি অনুসারে তার সত্যতা পাওয়া যায় না। তাই এখনও স্টুয়ার্ট-ডেসোটেলের আসা-যাওয়া তত্ত্বকে বেশি গ্রহণযোগ্য ধরে নেয়া যায়। ভবিষ্যতে কোনটা সত্য হয় সে নাহয় ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাকলো। তবে ভবিষ্যতের পাঠকদেরকে অনুরোধ করব আমাদের বইয়ের এই অংশটা একটু সতর্কতার সাথে পড়তে। আপাতত আমরা ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছি, সকল বৃহৎ নরবানরের (গিবন, গরিলা, ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জি, মানুষ) কনসেস্টর তথা সাধারণ পূর্বপুরুষ এশিয়াতেই বাস করতো।
২য় কনসেস্টর: জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তনকারী
স্টুয়ার্ট-ডিসোটেলের তত্ত্ব অনুসারে ১ কোটি বছর আগে এশিয়া থেকে নরবানররা আফ্রিকায় ফিরে আসে এবং আফ্রিকার নতুন পরিবেশে তাদের থেকে নতুন সব প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। এরপর ৭০ লক্ষ বছর আগে প্রাণবৃক্ষে আমাদের শাখা থেকে গরিলাদের শাখাটি আলাদা হয়ে যায়। তখনো উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মিলেনি, আন্দিজ পর্বতমালা তখনো এতোটা উঁচু হয়নি। তারপরও মহাদেশগুলোকে দেখতে অনেকটা আজকের মতোই লাগতো, আফ্রিকার জলবায়ু আরেকটু সিক্ত হলেও আগের চেয়ে খুব বেশি আলাদা ছিল না। আফ্রিকাতে তখন বনভূমির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, এমনকি বর্তমান সাহারা মরুভূমিতেও তখন কিছুটা সবুজের ছোঁয়া মিলতো।
প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ, গরিলা ও শিম্পাঞ্জির সাধারণ পূর্বপুরুষ তথা ২য় কনসেস্টরের সাথে এই তিনটি প্রজাতির মধ্যে কোনটির মিল সবচেয়ে বেশি? মানুষের মত হওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক হবে কারণ তখনো মানবীয় বৈশিষ্ট্য দেখা দিতে শুরু করেনি। আর গরিলা সাধারণ নরবানরদের তুলনায় একটু বেশিই দানবীয়। কনসেস্টরের এতোটা ব্যতিক্রমী হওয়ার কথা না। সে হিসেবে তার শিম্পাঞ্জির মত হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। তবে গরিলার অতিকায় দেহই শেষকথা নয়, এর চেয়ে বড় প্রাইমেটও এক সময় পৃথিবীতে বাস করেছে। চীনের জাইগান্টোপিথেকাস গণের সদস্যরা গরিলার পাশে দাঁড়ালে তাদের কাঁধ ও মাথা গরিলার মাথার উপরে থাকতো। মাত্র ৫ লক্ষ বছর পূর্বে এরা বিলুপ্ত হয়েছে। এত সাম্প্রতিক দেখে অনেকে এমনকি দাবী করে বসেছিলেন ইয়েতি নামক হিমালয়ের তুষারমানবদের যে পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে তা জাইগান্টোপিথেকাসকেই নির্দেশ করে। কিন্তু সেটা খুবই অসম্ভব, কারণ ৫ লক্ষ বছর আগে তিব্বত বা নেপালে মানুষের সমগোত্রীয় কোন প্রজাতি ছিলই না।
সূর্যের আলোর প্রভাবে কিভাবে গায়ের রং পরিবর্তিত হয় তা আমরা আরেক অধ্যায়ে দেখব। এখানে এটুকু বলে রাখছি যে, সূর্যের আলো বেশি পড়লে অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচতে গায়ের রং কালো হয়ে যায়। সুতরাং আফ্রিকার এই ২য় কনসেস্টরদের গায়ের রং যে গরিলা, শিম্পাঞ্জি ও আফ্রিকান মানুষদের মতোই কালো ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। শিম্পাঞ্জি ও গরিলার মতোই সম্ভবত তারা হাতের আঙুলের গাঁটে ভর করে হাঁটতো। শিম্পাঞ্জিদের মতো রাতের কিছুটা সময় তারা গাছেও কাটাতো, বিশেষ করে রাতের বেলায়। বনভূমির অভাব ছিল না বলেই হয়ত ৭০ লক্ষ বছর আগে গরিলারা নিজেদের দেহের আকার বাড়াতে কোন কার্পণ্য করেনি।
১ম কনসেস্টর: জেইন গুডলের হোমিনিন
আমরা প্রাণবৃক্ষে মানুষের নিজস্ব শাখাটির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। বাকি আছে কেবল আমাদের নিটকতম আত্মীয়দের কথা। জিনতত্ত্ব অনুসারে শিম্পাঞ্জিরাই আমাদের সবচেয়ে নিকটাত্মীয়। মানুষের গণ হোমো এবং শিম্পাঞ্জির গণ প্যান এর সকল সদস্যদেরকে হোমিনিন বলা হয়। আনুমানিক ৬০ লক্ষ বছর আগে ১ম কনসেস্টরের শাখা থেকে দুটো প্রশাখায় বের হয় যার একটিতে আছে সাধারণ শিম্পাঞ্জি ও বনবো শিম্পাঞ্জি, আর অন্যটিতে আধুনিক মানুষ। তবে এই তারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে। ৫০ থেকে ৭০ লক্ষ বছর আগের যে কোন সময় এটা হতে পারে। ৩০ লক্ষ বছর আগে শিম্পাঞ্জির শাখাটি দুই ভাগে ভাগ হয়েছিল যা থেকে জন্ম হয়েছে বর্তমান দুটি শিম্পাঞ্জি প্রজাতির। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে ফসিলের মাধ্যমে আমাদের কনসেস্টর থেকে শিম্পাঞ্জির বিবর্তন ইতিহাস একেবারেই জানা যায়নি। মানুষের পূর্বপুরুষদের অনেক ফসিল মিললেও তাদের সমসাময়িক শিম্পাঞ্জির একটি ফসিলও পাওয়া যায়নি। এর কারণ হতে পারে, শিম্পাঞ্জিরা বনের প্রাণী, এবং বনের মাটিতে ছড়িয়ে থাকা গাছের পাতা ফসিল সংরক্ষিত হতে দেয় না।
তবে শিম্পাঞ্জিদের দুই প্রজাতিতে ভাগ হয়ে যাওয়ার একটি কারণ আমরা দাঁড় করাতে পারি। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রতি বেশি সৎ থাকলে বলতে হয়, কোন সাধারষ পূর্বপুরুষ থেকে দুটি ভিন্ন প্রজাতি উদ্ভবের একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে পূর্বপুরুষদের দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে ভৌগলিক ব্যবধান সৃষ্টি যাতে এক অংশের সদস্যরা অনেক সময় ধরে অন্য অংশের সাথে মিশতে না পারে। অন্যথায় দুয়ের মধ্যে যৌন প্রজননের মাধ্যমে নতুন প্রজাতি সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে। ২০-৩০ লক্ষ বছর আগে এমনই একটি ভৌগলিক বাঁধ শিম্পাঞ্জির দুটি গোষ্ঠীকে আলাদা করে দিয়েছিল। বাঁধটি ছিল প্লাইস্টোসিন যুগে অর্থাৎ আনুমানিক ২০ লক্ষ বছর আগে সৃষ্টি হওয়া কঙ্গো নদী। বর্তমানে সাধারণ শিম্পাঞ্জিদের কেবল কঙ্গো নদীর উত্তরে এবং বনবোদেরকে কেবল নদীটির দক্ষিণে পাওয়া যায়।
এমনই আরেকটি বাঁধ মানুষ ও শিম্পাঞ্জির কনসেস্টরদের দুটি গোষ্ঠীকে প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে আলাদা করে দিয়েছিল বলে দাবী করেছিলেন অনেকে। এবার বাঁধ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল পূর্ব আফ্রিকার সেই গ্রেট রিফ্ট ভ্যালিকে। শিম্পাঞ্জিদেরকে এই উপত্যকার কেবল পশ্চিমে পাওয়া যায় এটা ঠিক। ফরাসি জীবাশ্মবিদ Yves Coppens এভাবে দুটি প্রজাতি সৃষ্টির ঘটনার একটা আকর্ষণীয় নামও দিয়েছিলেন- ইস্ট সাইড স্টোরি, অবশ্যই হলিউডের বিখ্যাত মিউজিক্যাল কমেডি সিনেমা ওয়েস্ট সাইড স্টোরির নামানুসারে। কিন্তু ইভেসের এই গল্প বোধহয় গল্পই থেকে গেছে, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মর্যাদা পেতে পারেনি। কারণ, রিফ্ট ভ্যালির অনেক পশ্চিমে সেই চাঁদে সাহেলানথ্রোপাস নামে একটি হোমিনিড ফসিল পাওয়া গেছে। এর পরে চাঁদে অস্ট্রালোপিথেকাস গণের একটি প্রজাতিও আবিষ্কৃত হয়েছিল। তাই মানুষ ও শিম্পাঞ্জির শাখা আলাদা হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ইস্ট সাইড স্টোরির চেয়ে ভাল ব্যাখ্যা লাগবে। সেই ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত গতি নেই।
মানব বিবর্তন শুরুর একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি আমরা। এই মুহূর্তে শিম্পাঞ্জি ও মানুষের কনসেস্টর সম্পর্কে আরেকটু জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। সেই একই প্রশ্ন আবার করতে পারি- সে দেখতে কার মত বেশি ছিল। আমাদের ধারণা শিম্পাঞ্জির মতোই বেশি ছিল, কারণ প্রাইমেট জগতে গরিলার মত মানুষও ব্যতিক্রম, মানুষ বোধহয় একটু বেশিই ব্যতিক্রম। তাই কোন কনসেস্টরের অপেক্ষাকৃত টিপিক্যাল প্রজাতিটিরই বেশি কাছাকাছি হওয়ার কথা। মানবীয় অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই এসেছে মানুষের শাখাটি আলাদা হয়ে যাওয়ার পর। তাই বলা যায়, আমাদের প্রথম কনসেস্টরটির গায়ে শিম্পাঞ্জির মত লোম ছিল, সে আঙুলের গাঁটে ভর করে হাঁটতো, কিছুটা সময় গাছে কাটালেও তার অধিকাংশ সময় কাটতো মাটিতে। তার মস্তিষ্ক ছিল শিম্পাঞ্জির সমান এবং আফ্রিকা ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও তার অস্তিত্ব ছিল না। সে সর্বভুক হলেও ফলের প্রতি একটু বেশি আসক্ত ছিল।
কনসেস্টরদের কিছুটা পরিচয় ধরে রাখার কৃতিত্ব যেমন শিম্পাঞ্জিদের তেমনি সেই পরিচয়টুকু আরেক উত্তরসূরী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কৃতিত্ব জেইন গুডলের, যিনি মানুষ হয়েও শিম্পাঞ্জিদের পরমাত্মীয়। এ প্রসঙ্গে ব্লগার তারেক অণুর একটি কথা যেন আমাদের সবার অনুভূতি প্রকাশ করে, “জেইন গুডল নামটি কানে প্রবেশ করলেই যে ছবিটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা একজন স্বর্ণকেশী তরুণীর, আলগোছে বসে সামনের দিকে একটি হাত আলতো বাড়িয়ে দিয়েছেন, তার মুখমণ্ডল খুব একটা দৃশ্যমান নয়, তার বাড়িয়ে দেয়া হাত ছোঁয়ার জন্য একটি আবেগি হাত ইতস্তত বাড়িয়ে দিয়েছে অপরপ্রান্ত থেকে এক শিশু শিম্পাঞ্জী, তার মুখে যাবতীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ করে সব কিছু ছাপিয়ে কৌতূহল আর সেই তরুণীর প্রতি তার বিশ্বাস ফুটে ওঠে চোখের তারা দুটোয়। এটিই সম্ভবত মানুষ এবং বুনো প্রাণীর সহাবস্থানের সবচেয়ে বিখ্যাত আলোকচিত্র।”

শিম্পাঞ্জিদের সাথে পরিচিত হওয়ার সময় আমরা তাদের যেসব কর্মকাণ্ড দেখেছি তার সবই প্রথম আবিষ্কার করেছেন জেইন গুডল। তিনি মানুষকে প্রথম জানিয়েছিলেন, শিম্পাঞ্জিরা শিকার করে, এক দল আরেক দলের সাথে যুদ্ধ করে, কাঠি দিয়ে ফাঁদ পেতে পোকা ধরে। বনের একেক অংশের শিম্পাঞ্জিদের একেক ধরণের কৌশল দেখেছিলেন তিনি, কোন গোষ্ঠীর শিম্পাঞ্জিরা কাঠি দিয়ে পোকা ধরে, কোন গোষ্ঠীর সদস্যরা আবার পাথরের টুকরো দিয়ে বাদামের খোসা ছাড়ায় যার বর্ণনা আমরা আগেই পেয়েছি। দেখা যাচ্ছে তাদের কৌশলগুলো পুরোই সাংস্কৃতিক। বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা ও সেখানতার শিম্পাঞ্জিদের ক্ষমতা অনুসারে হাতিয়ারের ব্যবহার বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। মানুষের হাতে বন্দি বনবোদেরকেও হাতিয়ার ব্যবহার করতে দেখা যায়। বনের বনবোরা এমনটি করে কিনা তা জানা যায়নি কারণ তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য কোন জেইন গুডল ছিলেন না। তবে বন্দিদশায় করলে বনভূমিতে না করার কোন কারণ নেই। শিম্পাঞ্জির দুটি প্রজাতিই যদি সক্রিয়ভাবে হাতিয়ার ব্যবহার করে তাহলে বলা যায় আমাদের ১ম কনসেস্টরও তা করতো।

বনবোদের উদার প্রেম, শিম্পাঞ্জিদের চতুর সংস্কৃতি, বেবুনদের হারেম, গিবনদের সঙ্গীত, মাকাকদের বর্ণবিদ্বেষ ইত্যাদি দেখে আমরা সকল প্রাইমেট প্রজাতির সাথে এক ধরণের একাত্মতা অনুভব করেছিলাম। এবার প্রাইমেটদের বিবর্তনের ইতিহাসটা জানার পর সেই একাত্মতার কারণটাও বোঝা গেল। আমরা এসেছি বিবর্তনের পথ ধরে, আমরা হলাম গিয়ে খাঁটি প্রাইমেট, আর আমরা কোথায় চলেছি সেটা বোধহয় আর প্রকৃতির হাতে নেই। কোথায় যাব সেটা নির্ধারণের ক্ষমতা এখন আমাদেরই আছে। এতোটা ক্ষমতাবান হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই আমরা প্রকৃতিরই সৃষ্টি এবং প্রকৃতির কাছে অনেক দিক দিয়েই অসহায়, আমরা চাইলেই সমুদ্রের নিচে বা মহাশূন্যে শ্বাস নিতে পারি না, আমরা চাইলেই এক তারা থেকে লাফ দিয়ে আরেক তারার দেশে চলে যেতে পারি না। তাই কোথায় যাব সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নিজেদের ইতিহাস জানা প্রয়োজন, সেই সাথে প্রয়োজন প্রকৃতিকে বোঝা এবং প্রকৃতিতে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে সতর্ক থাকা। নইলে অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে ফাঁদে পড়বো না তার নিশ্চয়তা কী? সেই সতর্কতা, সচেতনতা আর প্রজ্ঞা সৃষ্টিই হোক আমাদের এই বিবর্তন পাঠের উদ্দেশ্য।
তথ্যসূত্র
১। Richard Dawkins, “The Ancestor’s Tale”, Widenfeld & Nicolson
২। Connie Barlow, “Greet the Concestors: A Pilgrimage to Celebrate the Bonds of Kinship with All Life“, 2005
৩। Jan Klein, Naoyuki Takahata, “Where Do We Come From: The Molecular Evidence for Human Descent”, Springer 2002
৪। Peter Ward, “Impact From the Deep“, Scientific American, October 2006
৫। The First Primates, ANTHROPOLOGY TUTORIALS, Palomar College
৬। Roger Lewin, “Human Evolution: An Illustrated Introduction”, ৫ম সংস্করণ। অধ্যায় ১০: Primate Heritage
৭। Caro-Beth Stewart, Todd R. Disotell, “Primate evolution — in and out of Africa“, Current Biology, 1998
৮। তারেক অণু, “প্রিয় মুখ-১ : জেন গুডাল“, সচলায়তন, এপ্রিল ২৫, ২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন